
প্রজন্ম ডেস্ক:
বাংলাদেশ-ভারতের দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কে সবচেয়ে বেশি দিন ধরে অস্বস্তির কারণ হচ্ছে ফারাক্কা। পদ্মা নদীর উজানে ভারতের গঙ্গায় নির্মিত ফারাক্কা বাঁধ চালুর ৫০ বছরে আন্তঃসীমান্ত নদীর গতিপথে বিরূপ প্রভাব ফেলেছে বাংলাদেশের পদ্মাসহ এর শাখা নদ-নদীর ওপর। ভারতে ফারাক্কা পয়েন্টে গঙ্গার পানি সরিয়ে নেওয়ার কারণে বাংলাদেশের পদ্মায় চর জেগেছে, শুকিয়ে মরে গেছে এ নদীর উৎস থেকে সৃষ্ট পাগলা, মহানন্দা, পুনর্ভবা নদী। মৃত্যুপ্রায় কপোতাক্ষ, ভৈরব, মাথাভাঙ্গা, কুমার নদ-নদী।
ফারাক্কা বাঁধে বাংলাদেশের নদ-নদীতে যে বিরূপ প্রভাব পড়েছে তার বড় সাক্ষী পদ্মাপাড়ের মানুষ। ফারাক্কা পয়েন্টে ভারত পানি সরিয়ে নেওয়ায় শুষ্ক মৌসুমে মারাত্মক পানি সংকটে ভুগছেন তারা। আবার বর্ষাকালে সেই ফারাক্কারই সব গেট খুলে দেওয়া হচ্ছে। এর ফলে প্রায় প্রতি বছরই গঙ্গা ও পদ্মা অববাহিকার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে বন্যা ও ভাঙনের সমস্যা দেখা দিচ্ছে। প্রতি বছরই বাস্তুচ্যুত হচ্ছে পদ্মাপাড়ের মানুষ।
৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গার পানি বণ্টনচুক্তির মেয়াদও ২০২৬ সালে ফুরিয়ে যাচ্ছে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে শীতল সম্পর্ক বিরাজ করছে। দুই দেশের মধ্যে বর্তমান কূটনৈতিক সম্পর্কে এই চুক্তি নবায়ন হওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে। চুক্তিটি নবায়ন হলেও আগের মতো করে পানি ভাগাভাগি হবে কি না এ নিয়েও সংশয় রয়েছে। গঙ্গা নদী পানির ন্যায্য হিস্যা ভবিষ্যৎ পদ্মাপাড়ের মানুষের জীবন ও জীবিকা নির্ধারণ করবে।
নদী গবেষক ও সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের দীর্ঘতম এ নদীর গতিপথ থেকে শুরু করে এর শাখা নদ-নদীর প্রবাহে মারাত্মক ক্ষতি করেছে ফারাক্কা। শুষ্ক মৌসুমে পদ্মার বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে দেখা যায় ধু ধু বালুচর। আন্তঃসীমান্ত নদীগুলোর ন্যায্য হিস্যা, দর কষাকষি, নদীর অববাহিকা চুক্তি সম্পাদনে রক্ষাকবচ হিসেবে বিবেচিত আন্তজার্তিক সনদে বাংলাদেশ এখনও অনুস্বাক্ষর করেনি। দ্রুতসময়ে অনুস্বাক্ষরের পরামর্শ তাদের।
ফারাক্কা বাঁধ পশ্চিমবঙ্গের মালদাহ ও মুর্শিদাবাদ এলাকায় বাংলাদেশ সীমান্ত থেকে ১০ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত একটি বাঁধ। এই বাঁধের মাধ্যমে ভারত গঙ্গার জল নিয়ন্ত্রিত করে থাকে। ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত পদ্মা নদী। বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান এ নদীটি রাজশাহী বিভাগ দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে। আন্তঃসীমান্ত নদী বিষয়ে অচলাবস্থায় ভাটির দেশেরই ক্ষতি হয় সবচেয়ে বেশি। বাংলাদেশ-ভারতের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম ঘটেনি। গঙ্গার উজানের বিভিন্ন স্থানে ক্রমবর্ধমান হারে পানি প্রত্যাহার ছাড়াও তলে তলে চলছে সর্বনাশা আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের খণ্ড খণ্ড বাস্তবায়ন। ওদিকে সবচেয়ে বড় আন্তঃসীমান্ত নদী ব্রহ্মপুত্রে চীন যেমন একের পর এক জলবিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে, তেমনই ভারত শুরু করেছে একাধিক জলাধার ও জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের তোড়জোড়। এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন হলে গঙ্গা ও তিস্তার পর ব্রহ্মপুত্রেও অনিবার্যভাবে দেখা দেবে প্রবাহস্বল্পতা। যত দিন যাবে, পরিস্থিতির অবনতিই হতে থাকবে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, চাঁপাইনবাবগঞ্জ অংশের চারটি নদীর মধ্যে পদ্মা নদীর দৈর্ঘ্য ৩৫ কিমি, পাগলা নদী ৩৯ কিমি, পুনর্ভবা নদী ১৪.১২ কিমি ও মহানন্দা ৯৬ কিমি। এসব নদীর এখন করুণ অবস্থা। এসব নদীতে অল্প পরিমাণে পানি রয়েছে। পদ্মার চরাঞ্চল নারায়ণপুর এলাকার জেলে টমাস আলী বলেন, ফারাক্কার বাঁধ আমাদের জীবন শেষ করে দিয়েছে। তারা যখন ফারাক্কার দরজা খুলে দেয় তখন নদীভাঙনের মুখে পড়ে প্রতি বছর শত শত বাড়িঘর নদীগর্ভে বিলীন হয়ে যাচ্ছে। এই এলাকার বেশিরভাগ মানুষ আগে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করত। আর এখন শুষ্ক মৌসুম এলেই পদ্মা ধুধু বালুচর হয়ে যায়।
সেভ দ্য নেচার চাঁপাইনবাবগঞ্জের প্রধান সমন্বয়কারী রবিউল ইসলাম ডলার বলেন, পদ্মা নদী নাব্য হারিয়ে ফেলার কারণে জলজপ্রাণী শুশুক ও ঘড়িয়ালের প্রজনন ব্যাহত হচ্ছে। এ অবস্থা যদি চলতে থাকে তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জের জীববৈচিত্র্য হুমকির মধ্যে পড়বে।
স্থানীয় বিএনপি নেতা আসাদুল্লাহ আহমদ বলেন, ভারত ফারাক্কা বাঁধ দিয়ে আমাদের দুদিক থেকে ঘিরে ধরেছে। পানির যখন প্রয়োজন হয়, তারা পানি দেয় না। আর বর্ষা মৌসুমে পানি দিয়ে তারা আমাদের ডুবিয়ে মারার চেষ্টা করে। এই বাঁধ দিয়ে ভারত এ অঞ্চলে পানি শাসন ব্যবস্থা চালু করেছে।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের পানি উন্নয়ন বোর্ডের (পাউবো) নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম আহসান হাবীব বলেন, ফারাক্কার বাঁধ দেওয়ায় বিশেষ করে পদ্মায় বেশি প্রভাব ফেলেছে। আর এটি তো তারা নির্দিষ্ট করে একেক সময়ে একেক পরিমাণে পানি দিয়ে থাকে। পানি দেওয়ার হার খুব অল্প। বর্ষা মৌসুমে যখন বেশি পানি ছাড়ে, তখন এই এলাকার নদীগুলো বিপদসীমা অতিক্রম করে বিভিন্ন অঞ্চল প্লাবিত হয়। আর শুষ্ক মৌসুমে যখন চাহিদা অনুযায়ী পানি দেয় না তখন পদ্মা, মহানন্দা, পাগলা ও পুনর্ভবা নদী শুকিয়ে যায়।
এদিকে ফারাক্কার বিরূপ প্রভাবে পদ্মার বেশ কিছু শাখা নদ-নদী শুকিয়ে গেছে। পানিপ্রবাহ ক্ষতিগ্রস্ত প্রায় সব শাখা নদীর। পানি সংকটের কারণে পদ্মার যে শাখা নদীগুলো ক্ষতিগ্রস্ত তার একটি বড়াল। রাজশাহী থেকে ভাটিতে চারঘাটে বড়াল নদীর উৎসমুখ। বড়ালের উৎসমুখে বিশাল চর জেগেছে, সেখানে পানির প্রবাহ নেই। বড়ালের দুই পাশে চর পড়ে উঁচু হয়ে গেছে। মাঝখানে সরু নালার মতো।
স্থানীয়রা জানান, পদ্মা থেকে রাজশাহী, নাটোর হয়ে বড়াল নদীর গতিপথ যমুনা পর্যন্ত বিস্তৃত। বড়ালে মালবাহী নৌযানের সঙ্গে যাত্রীবাহী নৌকাও চলাচল করত। পানি সংকটে পদ্মার যে শাখা নদীগুলো সংকটে তার মধ্যে অন্যতম কুষ্টিয়ার গড়াই নদী অন্যতম। পদ্মায় গড়াই নদীর উৎসমুখেও দেখা যায় বিশাল চর জেগেছে। ড্রেজার দিয়ে নদী খনন করে গড়াই নদী বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা চলছে।
কুষ্টিয়া পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী রাশেদুর রহমান বলেন, গড়াই নদী হলো পদ্মার একমাত্র পানির উৎস। আর এই গড়াই নদী সুন্দরবন পর্যন্ত মিঠা পানির প্রধান সোর্স। আমাদের গড়াই নদীটায় টোটাল ৪৪ কিলোমিটার চর পড়ে গিয়েছিল। বর্তমানে আমরা গড়াই নদী ড্রেজিং ও তীর সংরক্ষণ প্রকল্পের মাধ্যমে সচল রাখছি। আর আমাদের কুষ্টিয়ায় ১১টি নদী আছে। এই নদীগুলো পদ্মা এবং গড়াই নদীর সঙ্গে লিংকআপ (যুক্ত)। এখন যদি টোটালি পদ্মায় পানি না পাওয়া যায় তা হলে এই নদীগুলো মৃতপ্রায় হয়ে যাবে।
নদী গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিভারাইন পিপলের মহাসচিব শেখ রোকন বলেন, ফারাক্কার বাঁধ ১৯৭৫ সালে চালু করা হয়। এর পরবর্তী ২০ বছর কোনো চুক্তি ছিল না। ১৯৯৬ সালে ৩০ বছর মেয়াদি গঙ্গা পানি বণ্টন চুক্তি করা হয়। এর মেয়াদ ২০২৬ সালে শেষ হবে। বাংলাদেশ-ভারত বর্তমান ক‚টনৈতিক সম্পর্কে এই চুক্তি নবায়ন হওয়া কঠিন।
তিনি বলেন, চুক্তিটি নবায়ন হলেও আগের মতো করে পানি ভাগাভাগি হবে কি না সন্দেহ রয়েছে। চুক্তি নবায়ন হলে মেয়াদি চুক্তি না করে স্থায়ী চুক্তি হতে হবে। মেয়াদি চুক্তিতে ঝামেলা হয়। এই নদী গবেষক বলেন, বর্তমান চুক্তিতে ফারাক্কা পয়েন্টে জমা পানির ভিত্তিতে পানি ভাগাভাগি হয়। ফারাক্কার উজানে ভারতের উত্তরপ্রদেশ, ঝাড়খাণ্ড অঞ্চলে পানি তুলে নেওয়া হয়। এতে ফারাক্কা পয়েন্টে পানি পুরো জমা হয় না। নদীর পুরো পানি পরিমাপ করে বণ্টন করা উচিত। আরেকটি বিষয় হচ্ছে নদীর পরিবেশ ঠিক থাকে সেভাবে পানি বণ্টন করা উচিত। পানি পুরো ভাগাভাগি করে নিলে নদীর ক্ষতি হয়।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ-ভারত ৫৪টি নদী আন্তঃসংযোগ আছে বলে স্বীকৃত। কিন্তু ১২৩টি নদীর সঙ্গে আন্তঃসংযোগ রয়েছে। ৬৯টি নদী তালিকায় নেই। আর তিনটি নদীর সঙ্গে চুক্তি বা সমঝোতা রয়েছে। এগুলো হচ্ছে গঙ্গা, ফেনী, মুহুরি নদী। অন্য নদীগুলো সমঝোতা বা চুক্তির বাইরে। গঙ্গা নদী অববাহিকা চুক্তি, ব্রহ্মপুত্র নদ অববাহিকা চুক্তি, বরাক নদী অববাহিকা চুক্তি করলে সব নদী চুক্তির আওতায় চলে আসবে। পানি বণ্টনের সুবিধা পাওয়া যাবে।
তিনি বলেন, অভিন্ন নদীর পানি বণ্টন নিয়ে আন্তর্জাতিক কনভেনশন-১৯৯২ ও জাতিসংঘ পানিপ্রবাহ কনভেনশন ১৯৯৭ বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর করেনি। এ চুক্তিতে অনুস্বাক্ষর করলে পানির ন্যায্য হিস্যা, দর কষাকষি, অববাহিকার চুক্তি স্বাক্ষরে আন্তজার্তিক রক্ষাকবচ হিসেবে কাজ করে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এসব চুক্তিতে বাংলাদেশ অনুস্বাক্ষর যেন না করে ভারতের পরোক্ষ চাপ তো ছিলই।
Sharing is caring!