প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৬ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

সোনা পাচারে ২০৯ সিন্ডিকেট

editor
প্রকাশিত মে ১৪, ২০২৫, ১২:৩১ অপরাহ্ণ
সোনা পাচারে ২০৯ সিন্ডিকেট

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

সোনার দাম বাড়ছে, পাশাপাশি সোনা পাচারও বেড়ে চলেছে। প্রায় প্রতিদিন সোনার চালান আসছে বাংলাদেশে; বিভিন্ন এয়ারলাইনসে করে। শাহজালালসহ তিনটি আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ব্যবহার করছে চোরাচালানিরা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো নানা কৌশল নিয়েও নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না তাদের। সোনা পাচার বেড়ে যাওয়ায় উদ্বিগ্ন বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।

সোনা পাচার নিয়ে শীর্ষ কর্তারা বৈঠক করছেন। গোয়েন্দাদের অনুসন্ধানে জানা গেছে, এ কারবারে কারা সম্পৃক্ত আছে। আন্তর্জাতিক একাধিক চক্র বাংলাদেশে সক্রিয়। তারা বেশিরভাগ সময় দেশের বাইরে অবস্থান করে। বাংলাদেশিরা তো রয়েছেই, ভারত, দুবাই, পাকিস্তান, সৌদি-আরব, চীন, মালয়েশিয়াসহ অন্তত দশটি দেশের মাফিয়ারাও আছে। তাদের কেউ কেউ আন্ডারওয়ার্ল্ডের সন্ত্রাসীদের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। ইতিমধ্যে পুলিশ সদর দপ্তর এবং শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তর একটি তালিকা করেছে। তাতে ২০৯ জনের নাম রয়েছে। তালিকাটি গত মাসে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে বলে পুলিশের একটি সূত্র জানিয়েছে।

ঢাকা কাস্টম হাউজের কমিশনার মুহম্মদ জাকির হোসেন বলেন, ‘অবৈধ পণ্য ও সোনা ধরা পড়ছে। এ কারণে আমাদের নজরদারি বাড়ানো হয়েছে। সব কর্মকর্তাকে বলে দেওয়া হয়েছে, অবৈধ পণ্য যেন কোনোভাবেই বের হতে না পারে। কর্মকর্তারা নির্দেশমতো দায়িত্ব পালন করছেন। কাস্টমসের প্রতিটি টিমের কর্মকর্তা তার সর্বোচ্চ দক্ষতার পরিচয় দিচ্ছেন। গোয়েন্দা সোর্স আরও বাড়ানো হয়েছে। বিমানবন্দরে অন্যান্য সংস্থার কর্মকর্তারাও সোনা পাচারকারীদের ধরার চেষ্টা করছেন।’

পুলিশ সদর দপ্তরের উপমহাপরিদর্শক (প্রশাসন) রেজাউল করিম বলেন, ‘সোনাসহ সব ধরনের চোরাচালান বন্ধ করতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কাজ করছে। দেশি হোক আর বিদেশি হোক, কেউ রেহাই পাচ্ছে না। সারা দেশেই পুলিশ নজরদারি করছে। বিমানবন্দরেও পুলিশ সক্রিয় রয়েছে চোরাকারবারিদের ধরতে। তালিকা ধরে আমরা কাজ করছি।’

ট্রানজিট রুট হিসেবে ব্যবহার : সংশ্লিষ্টরা বলেন, অনেক দিন ধরেই শাহজালাল, শাহ আমানত ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নানা রকমের অপরাধ কর্মকান্ড চলে আসছে। কর্তৃপক্ষ কৌশল নিয়েও কারও বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না। বিমানবন্দরগুলোয় অপরাধমূলক কর্মকা-ের শীর্ষে রয়েছে সোনা পাচার। আগের চেয়ে সোনা পাচার বেড়ে গেছে। প্রায় প্রতিদিন ধরা পড়ছে সোনার চালান। গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এ নিয়ে বিশেষভাবে তদন্ত করেছে। তারা নিশ্চিত হয়েছে বিদেশি এজেন্টদের পাশাপাশি দেশি এজেন্টরা বেপরোয়াভাবে সোনা চোরাচালানে জড়িয়ে পড়ছে। আন্তর্জাতিক মাফিয়ারা বাংলাদেশিদের সঙ্গে আঁতাত করে পাচার করছে সোনা।

বাংলাদেশে সক্রিয় মাফিয়াদের তাদের একটি তালিকা করা হয়েছে। তাদের মধ্যে বেশিরভাগই সোনা পাচারকারী। হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দীর্ঘদিন ধরেই সোনা পাচারের নিরাপদ রুট হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে। পাচার করার সময় সোনার বারসহ আটক হচ্ছে কারবারিরা। প্রত্যেকের বিরুদ্ধে থানায় মামলা হচ্ছে। কিন্তু কাউকে আটকে রাখা যাচ্ছে না। কোনো কোনো আসামি জামিন নিয়ে লাপাত্তা। তাদের কেউ দেশেই আত্মগোপনে রয়েছে, কেউ দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। ফলে সংশ্লিষ্ট মামলার তদন্ত ও উদ্ধার হওয়া সোনার বিষয়গুলো সুরাহা হচ্ছে না। আবার বিচারের দীর্ঘসূত্রতার কারণে সরকার বঞ্চিত হচ্ছে রাজস্ব থেকে।

পুলিশ ও কাস্টমস কর্মকর্তারা বলেছেন, ‘শুল্ক ফাঁকির এমন তৎপরতা আগে চোখে পড়েনি। পাচারে আগে লাগেজ, শরীর কিংবা ফ্লাইটের সিট ব্যবহার করা হতো। এখন রোগী সেজে, কিংবা সোনা গুঁড়ো করে ভিন্ন পদার্থ হিসেবে উল্লেখ করে পার করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে আমাদের নজরদারি অনেক বেড়েছে।’ তারা বলেন, আন্তর্জাতিক চক্রগুলো বাংলাদেশকে ট্রানজিট হিসেবে ব্যবহার করছে।

প্রতিবেদনে আন্তর্জাতিক মাফিয়াদের নাম : পুলিশ ও শুল্ক গোয়েন্দাদের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কয়েক বছর আগে ১২ কোটি টাকা মূল্যের সোনাসহ ধরা পড়েন জাপানি নাগরিক তাকিও মিমুরা ও চীনা নাগরিক জু জিয়াং। তবে তারা জামিন নিয়ে বেরিয়ে দেশের বাইরে পালিয়ে গেছেন এবং তারা আবারও একই কারবার চালাচ্ছেন। তারা কলকাতার আমির খানের মাধ্যমে বাংলাদেশ থেকে সোনা পাচারে ব্যস্ত। আমির খানও বাংলাদেশ পুলিশের কাছে ধরা পড়েছিলেন। বলা হয়েছে, ভারতের ঈশ্বর দাস, সৌরভ ম-ল, রমেশ কুমার ভার্মা, সালেকিন শেখ, সৌমিক দত্ত, কুলদীপ সিং, ওয়াসিম, দুবাইয়ের রমজান আলী, পাকিস্তানের আরশাদ আয়াজ আহমেদ, ভারতের গুজরাট সিং, প্রকাশ, রেখা, উর্মিলা কুমার, অনিক কুমার, বিনোদ কুমার, গুরজন্ত সিং, বিজয় কুমার, দিনেশ, পাকিস্তানের রাশেদ মো. খালেদ, চীনের চেন সিম ফাত, চেন জিলা, দিং শোশেং, জু ইয়ংগাং, লুতেংচেং, জাপানের শুইচি সাতো, মালয়েশিয়ার চ্যান গি কিউনগ, রাজা বসলিনা বিনতি, ক্যামেরুনের নোগোমবি বাছি, নাইজেরিয়ার নন্দিকা ক্লিনেন্ট, ক্লেটাস আছুনা, ওইউকুলভ টিমটি, একিন উইসডোম, দক্ষিণ আফ্রিকার চিগোজি, ইভুন্ডে গ্যাব্রিল ওবিনা, স্যালেস্টাইন প্যাট্রিক, মর্দি ন্যামডি, ওরদু চুকওরদু সাম্মি, ডুবুওকন সোমায়ইনা, জেয়েরেম প্রেসিয়াস, দিনাজুপুরের সোহেল রানা, নরসিংদীর মনির আহম্মেদ, নারায়ণগঞ্জের ওয়ায়েদউল্লাহ, মিরপুরের সাইফুল ইসলাম, নারায়ণগঞ্জের মঞ্জুর হোসেন, পল্লবীর সামসুল হুদা, মুন্সীগঞ্জের ইসলাম শেখ, রাজবাড়ির মোহাম্মদ হানিফ, মুন্সীগঞ্জের মোহাম্মদ রুবেল, ভারতের রূপসাহা, গোপাল বিজন, বিজন হালদার, লক্ষণ সেন, গোবিন্দ বাবু, লালু জয়দেব, গওহর প্রসাদ, সঞ্জিব, রামপ্রসাদ, মিন্টু, সুমন চ্যাটার্জী, রিয়াজ, তপন সাহা, ডালিম, মোনায়েম, ফারুক, বসাক চ্যাটার্জী ও স্বপন সাহাসহ ২০৯ জনের সিন্ডিকেট সোনা পাচারে জড়িত।

দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনসের কর্তাদের ওপর নজরদারি : দেশি-বিদেশি এয়ারলাইনসে করে সোনা পাচার হচ্ছে সবচেয়ে বেশি। এসবে কেবিন ক্রু থেকে শুরু করে সাধারণ কর্মচারীরা সম্পৃক্ত। এ প্রসঙ্গে পুলিশের এক কর্মকর্তা বলেন, ‘গ্রেপ্তার হওয়া কেবিন ক্রু রোকেয়া শেখ মৌসুমী দীর্ঘদিন সোনা পাচার করেছে। তাকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে। সৌদি এয়ারলাইনসের কেবিন ক্রু ফারজানা আফরোজ ও সায়মা আক্তারও একই কারবার করেছেন। বিদেশ থেকে আসার পর লাগেজ বা শরীর তল্লাশি না হওয়ার সুযোগে তারা এসব অপকর্ম করে। অন্য কর্মকর্তা ও সদস্যরাও এসব অপকর্ম করছে বলে আমরা নিশ্চিত হয়েছি। তাদের তালিকাও করা হয়েছে; নজরদারিতে রাখা হয়েছে।’ তিনি বলেন, বাংলাদেশ, ভারত, সিঙ্গাপুর, হংকং, মালয়েশিয়া, দুবাইসহ কয়েকটি দেশে সোনা কারবারিদের সিন্ডিকেট রয়েছে। তাতে বাংলাদেশি সদস্যও আছে।

আন্তর্জাতিক কারবারির জবানবন্দি : বছরখানেক আগে বিপুল পরিমাণ সোনাসহ গ্রেপ্তার হন আন্তর্জাতিক সোনা কারবারি মোহাম্মদ আলীসহ কয়েকজন। মোহাম্মদ আলী জবানবন্দি দিয়েছেন আদালতে। তিনি ১২ বছর ধরে সোনা পাচার করছেন। এর জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও রাজনৈতিক নেতাদের ম্যানেজ করতে হয়েছে। গুলশান ও বায়তুল মোকাররম এলাকায় অন্তত ১৭ জন ব্যবসায়ী তাকে সহায়তা করেছে। তারা তার কাছ থেকে নিয়মিত সোনা কিনতেন। হংকং, ভারত ও দুবাইয়ের প্রভাবশালী ব্যবসায়ীরা তাকে সোনা আলী নামে চেনেন। ভারতীয় নাগরিক রাজিব শুভ্র, পাপ্পু সাজ্জেল ও লাবু তার পার্টনার। মোহাম্মদ আলী ভারতে সোনার চালান পাচার করেছেন নিয়মিত। আরেক সোনা কারবারি ও ভারতীয় নাগরিক জামিল আহমেদ জবানবন্দিতে বলেন, আগে তিনি মোবাইল ব্যবসা করতেন। মোহাম্মদ আলীর মাধ্যমে সোনা পাচারে জড়ান। দুবাই থেকে তিনি সোনার চালান এনে বাংলাদেশের এজেন্টদের কাছে বিক্রি করতেন।

 

সব বিমানবন্দরেই সিন্ডিকেট : সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, দীর্ঘদিন ধরেই সিন্ডিকেটগুলো শাহজালাল, শাহ আমানত ও ওসমানী আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে সোনার চালান পাচার করছে। ওইসব জায়গায় তাদের শক্তিশালী নেটওয়ার্ক রয়েছে। তাদের সঙ্গে সম্পর্ক আছে জুয়েলারি দোকানের কিছু মালিকেরও। রাজনৈতিক কানেকশনও আছে। বিমান ও সিভিল অ্যাভিয়েশনের কিছু কর্মকর্তা ও কর্মচারীও চোরাকারবারিদের সহায়তা করছে। প্রকৃত চোরাকারবারিদের ধারে-কাছেও ভিড়তে পারছে না আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো। ফলে বড় চালান ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছে।

কাস্টমস ও আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলোর কর্মকর্তারা বলছেন, যত সোনা ধরা পড়ছে, তার কয়েক গুণ বেশি সোনা পাচার হচ্ছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। সোনা চোরাচালানে নিত্যনতুন কৌশল ও পদ্ধতি ব্যবহার করা হচ্ছে। চোরাকারবারিরা মধ্যপ্রাচ্যের দেশসহ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, দুবাই থেকে সোনা এনে বাংলাদেশ ও পাশের দেশগুলোর বাজারে সরবরাহ করছে। এতে বিমানবন্দরে কর্মরত ব্যক্তিদের যোগসাজশ রয়েছে। এ কাজে সহায়তা করে শুল্ক, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও বিমানের বিভিন্ন স্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। গত ২ মে সকালে দুবাই থেকে সিলেট (ফ্লাইট-ইএ২৪৮) হয়ে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে আসেন এক ব্যক্তি। কাস্টমস ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তার পোশাক খুলে হাতে নিলে স্বাভাবিকের চেয়ে ওজন বেশি দেখতে পান। তিনি চারটি আন্ডারওয়্যার, একটি ফুলপ্যান্ট ও তিনটি টি-শার্ট আগুনে পুড়িয়ে পেস্ট আকারে সোনার বার নিয়ে আসেন। ওই ব্যক্তি প্রায়ই বাংলাদেশে আসেন। তিনি একজন আন্তর্জাতিক সোনা পাচারকারী।

Sharing is caring!