
প্রজন্ম ডেস্ক:
ঘটনাটি ২০১৭ সালের ২৫ অক্টোবরের। সাত বছর সাত মাস পর আবার একই ঘটনা ঘটল। তাও আবার একই মডেলের ড্যাস-৮ এয়ারক্রাফটে। সেদিন এয়ারক্রাফটটি উড়েছিল সৈয়দপুর থেকে। গত শুক্রবার কক্সবাজার থেকে। দুবারই এয়ারক্রাফট থেকে চাকা খুলে পড়ে। প্রতিবারই এয়ারক্রাফটে ছিল ৭১ জন যাত্রী ও ক্রু। ক্যাপ্টেন ও পাইলটের দক্ষতায় প্রাণে বাঁচেন তারা।
বিমান বহরের এয়ারক্রাফটগুলোর নাটবল্টু বরাবরই নড়বড়ে। তা সেটা অভ্যন্তরীণ রুটের ফ্লাইট হোক বা আন্তর্জাতিক। এমনকি ভিভিআইপি হিসেবে প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী ফ্লাইটের নাটও নড়ে। এ কারণেই কি না এ ধরনের এয়ারলাইনসের যাত্রীরা এমনকি অফিসিয়ালরাও ‘দান-সদকায়’ মুক্তি খোঁজেন।
বারবার কেন এয়ারক্রাফট থেকে চাকা খুলে পড়ে? চাকা খুলে পড়ে গেলে ল্যান্ড করানো কতটা ঝুঁকিপূর্ণ? এসব বিষয় নিয়ে কথা হয়েছে কয়েকজন পাইলট এবং ইঞ্জিনিয়ারের সঙ্গে। তারা বলেছেন, এ রকম পরিস্থিতিতে পাইলটের দক্ষতাই আসল। পাইলটকে অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে ল্যান্ড করাতে হয়। প্রচ- ঝাঁকুনির সৃষ্টি হয়। এতে যাত্রীরা আতঙ্কিত হয়ে পড়েন। ঠিকমতো ল্যান্ড করাতে না পারলে এয়ারক্রাফট রানওয়ে থেকে ছিটকে যেতে পারে। এয়ারক্রাফটে ফাটল ধরতে পারে এবং আগুন লেগে যাওয়ার সম্ভাবনাও থাকে।
গত শুক্রবার এয়ারক্রাফটিতে ক্যাপ্টেন হিসেবে ছিলেন জামিল বিল্লাহ এবং তার ফার্স্ট অফিসার হিসেবে ছিলেন পাইলট জাওয়াদ। বিমানের কোড অব কন্ডাক্টের কারণে তাদের সঙ্গে কথা বলা সম্ভব হয়নি। বিমানও তাদের প্রেসের মুখোমুখি করানোর কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অথচ গত শুক্রবার এই চাকা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম এমনকি প্রতিষ্ঠিত গণমাধ্যমগুলো সরব ছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ক্যাপ্টেন-পাইলটের প্রশংসা করা হলেও বিমানের রক্ষণাবেক্ষণ নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভ ফুটে উঠেছে। এয়ারক্রাফট নিয়ে ক্যাপ্টেন ও পাইলট আকাশে ওড়ার আগে উড্ডয়ন উপযোগী কি না তা যাচাইবাছাই করা প্রকৌশল বিভাগের কাজ। তারা ধারাবাহিকভাবেই এ কাজে ব্যর্থতার পরিচয় দিচ্ছেন।
কক্সবাজার ও সৈয়দপুরের আগেও একটি আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের চাকা খুলে পড়ে যায়। ওমানের রাজধানী মাসকট থেকে চট্টগ্রামগামী বিমানের বোয়িং ৭৩৭ উড়োজাহাজটি উড্ডয়নের পরই এর চাকা থেকে একটি অংশ খুলে পড়ে বিমানবন্দরের রানওয়েতে। ঘটনাটি মাসকট বিমানবন্দর কন্ট্রোল টাওয়ারের নজরে এলে তখনই তা পাইলটকে জানানো হয়। ক্যাপ্টেন মাসকাট বিমানবন্দরে ফিরে যাবেন নাকি চট্টগ্রামের পথেই থাকবেনতা নিয়ে সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েন। পরে ঝুঁকি নিয়েই ১৫৯ যাত্রীসহ তিনি বাংলাদেশের আকাশ সীমায় আসেন। তবে পাইলট চট্টগ্রামে অবতরণ না করে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। কারণ ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা চট্টগ্রামের শাহ আমানতের তুলনায় অপেক্ষাকৃত ভালো।
২০১৬ সালের ২৭ নভেম্বর তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারি সফরে হাঙ্গেরি যাচ্ছিলেন। যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে তার বিমানটি তুর্কমেনিস্তানের আশখাবাদে জরুরি অবতরণ করে। এ নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। হাসিনার হাঙ্গেরি ফ্লাইটের এয়ারক্রাফটের ইঞ্জিনের নাট ঢিলা ছিল। যে কারণে ইঞ্জিনে জ্বালানির পরিমাণ দ্রুত হ্রাস পাচ্ছিল। ফলে ক্যাপ্টেন আশখাবাদে জরুরি অবতরণ করতে বাধ্য হন। এ কারণে দফায় দফায় কর্মকর্তা ক্রু ইঞ্জিনিয়ারদের গ্রেপ্তার করে জেলে পাঠানো হয়। পরে তাদের ছেড়েও দেওয়া হয়। ওই সময় ব্রিটেনের ডেইলি টেলিগ্রাফ এক প্রতিবেদনে বিশ্বের নিকৃষ্টতম ১১টি বিমান সংস্থার নাম প্রকাশ করে। তাতে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের নামটিও ছিল। ওই প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল ‘দ্য টোয়েন্টি ওয়ান ওয়ার্স্ট এয়ারলাইন্স ইন দা ওয়ার্ল্ড’। বিমানের সঙ্গে ওই তালিকায় আরও ছিল উত্তর কোরিয়ার ‘কোরিয়া এয়ার’, ‘সুদান এয়ারওয়েজ’, নেপালের ‘নেপাল এয়ারলাইনস’, ইরানের ‘মাড়ান এয়ার’, ইয়েমেনের ‘ইমেনিয়ার’ নামও।
গত শুক্রবার চাকা খুলে পড়ে যাওয়া এয়ারক্রাফটির রেজিস্ট্রেশন নম্বর এস২-এজেডব্লিউ। লিজে নেওয়া হয়েছিল। একইসঙ্গে এস২-এজিআর রেজিস্ট্রেশনের আরও একটি এয়ারক্রাফট লিজে নেওয়া হয়। এরমধ্যে শেষটির অবস্থা বড়ই করুণ, যা আর চালানোর উপযোগী নয়। জোড়াতালি দিয়ে এস২- এজেডব্লিউ চালানো হলেও যেকোনো সময় তাও বন্ধ হয়ে যাবে। ডি হেভেল্যান্ড নির্মাতা হলেও থার্ড পার্টি থেকে পুরনো এসব এয়ারক্রাফট ওয়েট লিজে নেওয়া হয়। ওয়েট লিজ হচ্ছে যে অবস্থায় এয়ারক্রাফট লিজ নেওয়া হয় নির্ধারিত সময় পরে সেই অবস্থায় ফেরত দিতে হবে। সেই অবস্থায় ফেরত না নিতে পারলে লিজে নেওয়া এয়ারক্রাফট কিনে নিতে বাধ্য থাকবে। বিমান চেষ্টা করেও এসব এয়ারক্রাফট ফেরত দেওয়ার মতো অবস্থানে নিতে পারেনি। কাজেই এগুলো কিনতে বাধ্য হয় বিমান। লিজে এয়ারক্রাফট কেনার জন্য বিমানের একটি চক্র সব সময় সক্রিয়। সেই চক্রটি এখনো আছে। লিজের বেড়াজাল ভেঙে নতুন এয়ারক্রাফট দিয়ে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনস চালানোর পরিকল্পনা থাকলেও আবারও সেই লিজেই ফেরত যাচ্ছে।
এ ধরনের দুর্ঘটনায় বিমানের ইঞ্জিনিয়াররা শাস্তির আওতায় আসেন কি না জানতে চাইলে একজন পরিচালক বলেন, শাস্তি দিলেও তারা শাস্তি ভোগ করেন না। নানা কায়দা কানুন করে, এখানে সেখানে টাকা পয়সা দিয়ে চাকরিতে ফিরে আসেন। দুই বছর আগে বিমানের একটি অত্যাধুনিক এয়ারক্রাফট টারমাক থেকে হ্যাঙ্গারে টেনে নেওয়া হচ্ছিল। বিমানের ইঞ্জিনিয়াররাও সেখানে ছিলেন। এ ঘটনায় চাকরিচ্যুত হলেন একজন সুইপার সুপ্রহ ঘোষ। আরও কয়েকজন ইঞ্জিনিয়ার বরখাস্ত হয়েছিলেন। গত দুই বছর যাবৎ তাদের বকেয়া বেতন ভাতাসহ তারা বীরদর্পে বিমানে পুনর্বহাল হয়েছেন।
ওই পরিচালক জানান, বিমানের বদনাম যেমন আছে সুনামও আছে। পাইলটরা সেই সুনাম কুড়িয়ে এনেছেন। পুরনো নড়বড়ে উড়োজাহাজ নিয়ে তারা নিরাপদে গন্তব্যে গেছেন বহু বছর। দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ায় পাইলটরা দক্ষতার সঙ্গে বিমান ল্যান্ডিং করিয়েছেন। ২০২১ সালের ২৭ আগস্ট ওমানের রাজধানী মাসকাট থেকে ঢাকা আসার পথে বিমানের একটি ফ্লাইট ভারতের নাগপুর বিমানবন্দরে অবতরণ করান ক্যাপ্টেন নওসাত আতাউল কাইয়ুম। ১৪৯ যাত্রীর প্রাণ বাঁচাতে পারলেও পাইলট নিজে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যান। শুক্রবার এয়ারক্রাফটটি নিরাপদে ল্যান্ডিং করিয়ে মানুষের নজর কেড়েছেন ক্যাপ্টেন জামিল বিল্লাহ। বিমানের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতি এক জিনিস আর পাইলটদের দক্ষতা আরেক জিনিস। দুটোকে এক পাল্লায় মাপা ঠিক হবে নাবলে মন্তব্য করেন বিমানের পরিচালক।
সার্ভিস যাই হোক বিমানের ইঞ্জিনিয়ারদের রমরমা অবস্থা। ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর তাদের অবসরের বয়স ৫৯ বছর থেকে ৬২ বছরে উন্নীত করা হয়েছে। ইঞ্জিনিয়ারদের সার্টিফিকেট বাবদ ভাতা নামে এক অদ্ভুত কিসিমের ভাতা দেওয়া হয়। এর পরিমাণ সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা।
২০১৬ সালের ১৮ ডিসেম্বর পাকিস্তানের ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইনস পিআইএ’র একটি এয়ারক্রাফট নিরাপদে যাত্রা করার জন্য একটি কালো ছাগল টারমাকেই জবাই করা হয়। তার কয়েকদিন আগে ফ্রান্সের নির্মিত টার্বোপ্রোপ পিআইএ এর এটিআর ৪২ দুর্ঘটনায় ৪৭ আরোহীর মৃত্যু হয়। তারপর ওই সিরিজের সব এয়ারক্রাফট উড্ডয়ন স্থগিত করা হয় পরীক্ষা-নিরীক্ষার জন্য। এর কয়েকদিন পর যখন নতুন করে যাত্রা শুরু হয় তখন এই সদকা দেওয়া হয়। তৎকালীন প্রধানমন্ত্রীকে বহনকারী বিমানের নাট ও পিআইএয়ের ছাগল সদকা তখন খুব আলোচিত বিষয় ছিল।
গত শুক্রবার বিমানের চাকা খুলে পড়ে যাওয়া ওই ফ্লাইটে নিরাপদে ঢাকায় ফেরার কৃতজ্ঞতা হিসেবে এক নারী যাত্রীও সদকা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে।
Sharing is caring!