প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৬ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

যানজটে কমছে গণপরিবহনের গতি, বাড়ছে ব্যক্তিগত যান

editor
প্রকাশিত মে ১৮, ২০২৫, ১০:১০ পূর্বাহ্ণ
যানজটে কমছে গণপরিবহনের গতি, বাড়ছে ব্যক্তিগত যান

প্রজন্ম ডেস্ক:

যানজটের কারণে রাজধানীতে চলাচলকারী বাসগুলোর গতি ঘণ্টায় মাত্র ৯ দশমিক ৭ কিলোমিটার। ঢাকায় অন্তত ১৪ ঘণ্টা চলাচল করে, এমন বাসগুলো দৈনিক ১২০-১৪০ কিলোমিটার পরিক্রমণ করতে পারে। অথচ ঈদের ছুটিতে এই গতি দ্বিগুণ হয়। এতে শুধু যে বাসগুলোর দৈনিক পরিবহনক্ষমতা কমে গেছে তা নয়; নষ্ট হচ্ছে মূল্যবান কর্মঘণ্টা।

 

ঢাকার জন্য হালনাগাদ করা কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনা (আরএসটিপি) প্রণয়নের জন্য সম্প্রতি একটি জরিপ পরিচালনা করেছে ঢাকা পরিবহন সমন্বয় কর্তৃপক্ষ (ডিটিসিএ)। এতে দেখা গেছে, এক থেকে পাঁচ কিলোমিটার পর্যন্ত সড়কে চলাচল করতে নাগরিকরা রিকশার ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন। এতে নগরীর সড়কে ব্যাটারিচালিত রিকশা, ইজিবাইকের দৌরাত্ম্য বাড়ছে; যা নগরের পরিবহন-ব্যবস্থাকে গভীর সংকটে ফেলেছে।

ঢাকার সড়কে চলাচলকারী নাগরিকদের মধ্যে ২৪ শতাংশ পুরুষের নিজস্ব মোটরসাইকেল আছে; নারীদের মধ্যে এই হার ১৬ শতাংশ। প্রাইভেট কার ব্যবহার করছেন ২ দশমিক ২ শতাংশ। ২০০৪ সালে রাজধানীবাসীর মধ্যে ৩ দশমিক ৪ শতাংশ মোটরসাইকেলে যাতায়াত করতেন, ২০২৩ সালে তা দাঁড়িয়েছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশে। নগরের সড়কে যানজটে ব্যক্তিগত যানবাহনের দায়ও কম নয়।

এমন পরিস্থিতিতে নড়েচড়ে বসেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ। সড়ক খাতসংশ্লিষ্ট সরকারি-বেসরকারি কর্মকর্তা ও গবেষকদের সমন্বয়ে আরএসটিপি প্রণয়ন করে ঢাকার সড়ককে নতুনভাবে সাজানোর উদ্যোগ নিয়েছেন।

কী আছে কৌশলগত পরিবহন পরিকল্পনায়

ঢাকার লক্কড়ঝক্কড় বাস উঠিয়ে নিয়ে হাতিরঝিলের চক্রাকার বাসের মতো গণপরিবহন সড়কে নামানোর পরিকল্পনা করছে ডিটিসিএ এবং ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। বিশ্বব্যাংকের ১০ মিলিয়ন ডলারে এসব বাস কেনার পরিকল্পনা রয়েছে ডিটিসিএর। এখন এ বাসগুলো কবে কীভাবে কেনা হবে, এ নিয়ে বিস্তর পরিকল্পনা চলছে। বিস্তারিত তথ্য জানাতে নারাজ ডিটিসিএর কর্মকর্তারা।

ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক কাজী জুবায়ের মাসুদ বলেন, এসব বাসের চেসিস ভারতের, প্রতিটির মূল্য ২৪ লাখ টাকা। মূল বডির দাম ১২ লাখ টাকা। সব মিলিয়ে ৩৬ লাখ টাকা। তবে এসব বাস কিনতে হয় কিস্তিতে, তাই সুদসহ ৪৪ লাখ টাকা খরচ হবে আমাদের। বেসরকারিভাবে এসব বাস কিনতে আমরা সরকারের প্রণোদনা চেয়েছি। সরকার যদি সহযোগিতা করে তবে লক্কড়ঝক্কড় বাস উঠিয়ে আমরা এই নতুন বাসগুলো নামাব।

বিশেষজ্ঞদের মতে, ঢাকার সড়ক অবকাঠামোর বড় দুর্বলতা হলো- অধিকাংশ সড়ক উত্তর-দক্ষিণমুখী, যার ফলে পূর্ব-পশ্চিমের সড়ক সংযোগ দুর্বল। এই ভারসাম্যহীনতা শহরের কার্যকর ট্রাফিক-ব্যবস্থাকে ব্যাহত করে। এই সংকট নিরসনে গ্রিড আকৃতির সড়ক নেটওয়ার্ক তৈরি করে নগরীর সব দিকের সংযোগ আরও কার্যকর করার কথা বলা হয়েছে নতুন নগর পরিবহন পরিকল্পনায়। যানজট নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ সড়কগুলোর সংযোগস্থলে আন্ডারপাস নির্মাণের কথা বলা হচ্ছে। সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের অভ্যন্তরীণ রিং রোড ও মধ্যবর্তী রিং রোড নির্মাণের প্রকল্পও বাস্তবায়নের কাজ শুরু করতে তাগাদা দেওয়া হয়েছে।

রোড প্রাইসিং-ব্যবস্থার কথা নতুন নগর পরিকল্পনায় রাখা হয়েছে। রোড প্রাইসিং এমন একটি পরিবহন ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি, যার মাধ্যমে সড়ক ব্যবহারের জন্য নির্দিষ্ট পরিমাণ টাকা বা ফি নেওয়া হয়। যেসব এলাকায় বা সময়ে অতিরিক্ত যানজট হয়, সেখানে গাড়ি চালাতে হলে বাড়তি খরচ (ফি) গুনতে হয়। এতে করে মানুষ ব্যক্তিগত গাড়ির পরিবর্তে গণপরিবহন বা বিকল্প পথ ব্যবহার করতে উৎসাহিত হন। রাজধানীর মতিঝিল, গুলশান, বনানী, উত্তরা, ধানমন্ডির মতো এলাকা যেখানে বেশি যানজট হয়, সেখানে নির্দিষ্ট সময়ে ঢোকার জন্য ফি ধার্য করা যেতে পারে বলে পরিবহন বিশেষজ্ঞরা মত দিয়েছেন।

আরএসটিপির পরিকল্পনায় বলা হয়েছে, নগরের সড়কে বাসের গতি বৃদ্ধির জন্য তিন লেনবিশিষ্ট একমুখী সড়কের একটি লেন শুধু বাস চলাচলের জন্য নির্ধারিত করতে হবে। ব্যস্ত সময়গুলোতে নগরীর সংকীর্ণ রাস্তা একমুখী করে মিনিবাস পরিচালনা করার কথা বলা হয়েছে। নগরীর বিভিন্ন মোড়ে বাসের জন্য পৃথক কিউ-জাম্পিং লেন, ট্রাফিক সিগনালে বাস অগ্রাধিকার, বাসে থাকা ট্রান্সপন্ডারের মাধ্যমে সিগনাল নিয়ন্ত্রণ করার পরিকল্পনা রয়েছে। ডান দিকের মোড় বন্ধ করা, পার্শ্বরাস্তা সীমিতকরণের কথা বলা হয়েছে।

আছে অনেক বাধা

নগরে আধুনিক সুবিধাসংবলিত বাস নামানো হলে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বাড়বে বলে জানিয়েছে ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি। এই সমিতির নেতা কাজী জুবায়ের মাসুদ বলেন, ‘আমাদের নতুন বাস কিনতে যে খরচ হবে, তা উঠিয়ে নিতে প্রতি কিলোমিটারে ভাড়া বাড়াতে হবে। আমরা প্রতি কিলোমিটারে ৩ টাকা ৭৫ পয়সা দাবি করছি, যা এখন ২ টাকা ৪৫ পয়সায় আছে। ভাড়া বাড়ানো না হলে আমাদের লগ্নি করা অর্থ তুলে আনা মুশকিল।’

২০৪৫ সাল পর্যন্ত পরিবহন খাতের চারটি পরিকল্পনার বিনিয়োগ ব্যয় নিয়েও প্রশ্ন আছে। আরএসটিপির একটি সভায় মতামত এসেছে, পরিবহন খাতে ভিত্তি পরিকল্পনার ব্যয় সবচেয়ে কম, প্রায় ৬০ বিলিয়ন ইউএস ডলার। গণপরিবহন-ব্যবস্থার উন্নয়নে পরিকল্পনার ব্যয় প্রায় ৭১ বিলিয়ন ডলার। সর্বোচ্চ পরিবহন উন্নয়ন পরিকল্পনার ব্যয় দাঁড়াবে প্রায় ৮২ বিলিয়ন ডলারে। প্রশ্ন উঠেছে এই বিপুল পরিমাণ অর্থ কীভাবে উঠে আসবে। এতে আরএসটিপি সদস্যরা মতামত দিয়েছেন, গণপরিবহনের উন্নয়নে এই বিপুল অর্থ সরকার রোড প্রাইসিং ও পাবলিক প্রাইভেট পার্টনারশিপ প্রকল্পের (পিপিপি) মাধ্যমে পূরণ করতে পারে।

ডিটিসিএ ও বুয়েটের পরিবহন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিপিপি প্রকল্পের বড় সমস্যা হলো সঠিক সময়ে অর্থায়ন; দরপত্র প্রক্রিয়ায় পক্ষপাতিত্ব ও রাজনৈতিক প্রভাব। এর আগে বিভিন্ন মেগা প্রকল্পে চুক্তির অস্বচ্ছতায় প্রকল্প বাস্তবায়নের সময় বেড়েছে, বেড়েছে অর্থ অপচয়। এ ছাড়া সরকারের বিভিন্ন দপ্তরের সমন্বয়হীনতার চিত্র তো ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে প্রকল্পে দৃশ্যমান।

রোড প্রাইসিং পরিকল্পনা বাস্তবায়নে অনেক চ্যালেঞ্জ আছে। ঢাকার রাস্তাগুলো খুবই সংকুচিত। বিকল্প গণপরিবহন-ব্যবস্থাও নেই। সব সড়কে হাতিরঝিলের মতো চক্রাকার বাস পরিচালনা করা যাবে না। ডিজিটাল টোলিং, সিসিটিভি, অটোমেটিক নাম্বার প্লেট, রিকগনিকশন ক্যামেরা স্থাপন করাও ঢাকার সড়কের বিদ্যমান ব্যবস্থায় দুরূহ।

 

বিশেষজ্ঞ অভিমত

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, ‘শুরুতে খুব বেশি অর্থ খরচ না করে প্যারা ট্রানজিট সিস্টেমের দিকে আমাদের যেতে হবে। সেসব সড়ক বাস চলাচলের জন্য উপযোগী না, সেখানে আধুনিক ম্যাক্সি সার্ভিস চালু করা যেতে পারে। আমাদের যে সড়ক কাঠামো, তাতে একটা লেন বাসের জন্য ডেডিকেটেড করা খুব কঠিন না। তার জন্য সড়ক ব্যবস্থাপনা ঠিক করতে হবে। হকারদের ভ্যান সরিয়ে দিলেই সড়ক আরও প্রশস্ত হবে। ওভারপাস, আন্ডারপাস নির্মাণ বিলাসী প্রকল্প। রোড প্রাইসিং চালু করতে গেলে আমাদের অটোমেটেড সিস্টেম ডেভেলপমেন্টের দিকে নজর রাখতে হবে।’

বুয়েটের অ্যাকসিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এআরআই) সহকারী অধ্যাপক কাজী সাইফুন নেওয়াজ বলেন, ‘আমরা যদি সড়কে যানজট কমাতে পারি, তাহলে সড়কে চলাচলকারী বাসগুলো কিন্তু লাভের মুখ দেখবে। তখন বাসমালিকরাই উদ্যোগী হয়ে নতুন বাস নামাবে। একটা লেন যখন বাসের জন্য ডেডিকেটেড করা হবে, তখন দ্রুত গন্তব্যে যেতে মানুষ গণপরিবহন ব্যবহার করবে।’

রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান বলেন, ‘ঢাকার যানজটে বসে প্রতিবছর মাথাপিছু আয় কমছে ৪৫ হাজার কোটি টাকা। নারীরা গণপরিবহনে উঠতে পারছেন না। তাদের জন্যও আলাদা পরিকল্পনা থাকতে হবে।’

আধুনিক গণপরিবহনের ভাড়া বৃদ্ধির বিষয়ে ডিটিসিএর নির্বাহী পরিচালক নীলিমা আখতার বলেন, ‘নগরে আধুনিক গণপরিবহনের মধ্যে এসি, নন-এসি দুই ধরনের বাসই থাকবে। দুই ধরনের বাসের ভাড়া আমরা নির্ধারণ করে দেব। খুব বেশি ভাড়া নেওয়ার সুযোগ থাকবে না।’

Sharing is caring!