
প্রজন্ম ডেস্ক:
আগামী বছর এপ্রিলের প্রথমার্ধে ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের কথা জানিয়ে ছিলেন প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তবে গতকাল লন্ডনে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর সে সময় আরও এগিয়ে আসে। এখন আগামী বছরের ফেব্রুয়ারিতে নির্বাচন- সেটা মোটামুটি নিশ্চিত। নির্বাচন আয়োজনে ইসির প্রস্তুতিই কতখানি- তা নিয়ে এখন চলছে জোর আলোচনা।
রোডম্যাপের বিষয়ে নির্বাচন কমিশনার (ইসি) আনোয়ারুল ইসলাম সরকার বলেন, সরকারি ছুটি শেষ হলে আগামী রোববার আমরা কমিশনের একটা মিটিং করে এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেব। রোডম্যাপ কবে হবে এখন বলা যাবে না। অফিস খোলার পর যত দ্রুত সম্ভব মিটিং করে আমরা জানাব। আগামী সপ্তাহ পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে। সব বিষয়ে পরিষ্কার হতে আরও কিছুদিন লাগবে।
এপ্রিলে ভোট হলে চ্যালেঞ্জ হবে কি না এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সবার সহযোগিতা পেলে আমাদের কোনো চ্যালেঞ্জ নেই। যেকোনো সময় নির্বাচন আয়োজন করা সম্ভব।
ইসির তথ্য অনুযায়ী অতীতে প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের অন্তত দেড় বছর আগে রোডম্যাপ প্রকাশ করেছে ইসি। প্রধান উপদেষ্টার ঘোষিত সময়সীমা অনুসারে আগামী বছরের এপ্রিলের প্রথমার্ধে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হলে এবার সময় আছে কম-বেশি ১০ মাস। কিন্তু এবার পরিস্থিতি ভিন্ন। ২০২৬ সালে এপ্রিলের প্রথমার্ধে নির্বাচন আয়োজনে প্রধান উপদেষ্টার ঘোষণা এলেও এখনও রোডম্যাপ দেয়নি নির্বাচন কমিশন। তাই প্রশ্ন তৈরি হয়েছে নির্বাচন আয়োজনের বিশাল কর্মযজ্ঞ এই সময়ের মধ্যে গুছিয়ে নেওয়া সম্ভব হবে কি না।
এই সময়ের মধ্যে চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ, সংসদীয় আসন পুনর্বিন্যাস, নতুন দল নিবন্ধন, পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন, নির্বাচনি সরঞ্জাম কেনাকাটা, ব্যালট পেপার প্রস্তুত, নির্বাচনি কর্মকর্তা নিয়োগের মতো কাজ সম্পাদন করতে হবে ইসিকে। আর ভোটের ৪৫ থেকে ৫০ দিন আগে ফেব্রুয়ারির শেষ দিকে করতে হবে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা। দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনের আগে ৫৩ দিন সময় দিয়ে তফসিল ঘোষণা করেছিল ইসি।
স্থানীয় পঞ্জিকা অনুযায়ী, চাঁদ দেখাসাপেক্ষে ২০ ফেব্রুয়ারি রমজান শুরু হতে পারে। ঈদুল ফিতর হতে পারে ২০ মার্চ। এ ক্ষেত্রে ৪৫ থেকে ৫০ দিন আগে রমজানের মধ্যে সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করতে হবে ইসিকে। একইভাবে রমজানের মধ্যেই মনোনয়নপত্র দাখিল ও প্রত্যাহার, প্রতীক বরাদ্দসহ নির্বাচনের গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম শেষ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে নানান চ্যালেঞ্জে পড়তে পারে নির্বাচন কমিশন। রমজানে তফসিল, মনোনয়নপত্র দাখিল, প্রচার নিয়ে বিপাকে পড়বেন প্রার্থীরা।
বিশ্লেষকদের মতে, রমজানের মধ্যে তফসিল দেওয়া থেকে নির্বাচনি অন্যান্য কার্যক্রম পরিচালনা করা ইসি, রাজনৈতিক দল ও প্রার্থীদের জন্য অসম্ভব হয়ে যাবে। তফসিল ঘোষণার পরপরই দেশব্যাপী নির্বাচনি আমেজ শুরু হয়। চলতে থাকে মিছিল-সমাবেশ। রমজানের মধ্যে নির্বাচনি প্রচার ও আমেজে ভাটা পড়তে পারে। এ ছাড়া এপ্রিলে এসএসসি পরীক্ষাও হতে পারে। আর পরীক্ষার আগে দেশব্যাপী নির্বাচনি আমেজে শিক্ষার্থীদের লেখাপড়া নিয়েও সংকট দেখা দিতে পারে।
সাবেক নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলাম বলেন, আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে নির্বাচনের জন্য উপযুক্ত সময় হচ্ছে ডিসেম্বর ও জানুয়ারি মাস। সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়া অনুযায়ী অতীতের সব নির্বাচন এই সময়ের মধ্যে হয়েছে। কিন্তু বর্তমান প্রেক্ষাপট ভিন্ন। এখন একটা বিশেষ সময় চলছে। এই সময়ে দেশের স্বার্থে যেকোনো সময়ে নির্বাচন সম্ভব। এপ্রিলে নির্বাচন হলে ৪৫ দিন আগে ফেব্রুয়ারিতে তফসিল ঘোষণা করতে হবে। রোজায় তফসিল হলে কোনো বাধা নেই।
তিনি বলেন, নির্বাচনি প্রচারের জন্য কোনো সময় নির্ধারিত না। তফসিল ঘোষণার ১৫ দিন থেকে একমাস পর্যন্ত প্রচারের জন্য সময় দিতে পারে। এটা নির্ভর করে পরিস্থিতির ওপর।
রোডম্যাপের বিষয়ে তিনি বলেন, রোডম্যাপ তেমন কিছু না। এটা নির্বাচন কমিশনের একটি কর্মপরিকল্পনা ঘোষণা। সেখানে বিভিন্ন কর্মপরিকল্পনার সময়গুলো উল্লেখ করা হয়। এ সবকিছু নির্ভর করছে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার ওপর।
ইসির কর্মকর্তারা বলছেন, ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমের বাইরে সংসদীয় আসনের সীমানা নির্ধারণ ও নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের প্রাথমিক কাজ চলছে। নির্বাচনি আচরণবিধি, ভোটারকেন্দ্র স্থাপন নীতিমালাসহ কিছু আইন ও বিধিমালা সংস্কারের কাজও চলছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের আলোচনার মাধ্যমে কী ধরনের সিদ্ধান্ত আসে, তার ভিত্তিতে নির্বাচনি আইন ও বিধি সংস্কার কার্যক্রম চূড়ান্ত হবে। আগামী জুলাই মাসে ঐকমত্য কমিশন জুলাই সনদ করার লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। সেটি হলে জুলাই-আগস্ট নাগাদ আইনবিধি সংস্কার চূড়ান্ত করা সম্ভব হবে।
এ ছাড়া রিটার্নিং ও সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয় ভোটের তফসিলের সময়। সাধারণত জেলা প্রশাসকদের রিটার্নিং কর্মকর্তা, উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও ইসির নিজস্ব কর্মকর্তাদের সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তা নিযুক্ত করা হয়। আর প্রিসাইডিং, সহকারী প্রিসাইডিং ও পোলিং কর্মকর্তা নিয়োগ করা হয় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের। এটি চূড়ান্ত করা হয় তফসিল ঘোষণার পর। এরপর তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়।
ইসি সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনের বড় প্রস্তুতির মধ্যে আছে ছবিসহ ভোটার তালিকা তৈরি, সংসদীয় আসনের সীমানা পুনর্নির্ধারণ, ভোটকেন্দ্র স্থাপন, ভোটের জন্য প্রয়োজনীয় কেনাকাটা, নির্বাচনি দায়িত্ব পালনকারী কর্মকর্তাদের নিয়োগ ও প্রশিক্ষণ, নতুন রাজনৈতিক দলের নিবন্ধন ও দেশি পর্যবেক্ষক সংস্থার নিবন্ধন দেওয়ার মতো কাজগুলো। এর মধ্যে বেশ কিছু প্রস্তুতি নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার আগে শেষ করতে হয়।
এ ধরনের প্রস্তুতিমূলক কাজগুলো এগিয়ে নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন নির্বাচন কমিশনার আনোয়ারুল ইসলাম সরকার। তিনি বলেন, ভোটের প্রস্তুতি হিসেবে আমাদের রুটিন ওয়ার্ক চলছে। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ অনেকটা শেষ পর্যায়ে, নতুন রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের জন্য বেঁধে দেওয়া সময়ও শেষের দিকে, পর্যবেক্ষক নিয়োগও একটা পর্যায়ে রাখা আছে। সার্বিক পরিস্থিতি বিবেচনায় এগুলো ফাইনাল হবে।
উল্লেখ্য, ঈদুল আজহার আগের দিন গত শুক্রবার জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস বলেছেন, ‘বিচার, সংস্কার ও নির্বাচন-সংক্রান্ত চলমান সংস্কার কার্যক্রম পর্যালোচনা করে আমি দেশবাসীর কাছে ঘোষণা করছি যে, আগামী জাতীয় নির্বাচন ২০২৬ সালের এপ্রিলের প্রথমার্ধের যেকোনো একটি দিনে অনুষ্ঠিত হবে। এই ঘোষণার ভিত্তিতে নির্বাচন কমিশন উপযুক্ত সময়ে আপনাদের কাছে নির্বাচনের বিস্তারিত রোডম্যাপ (পথনকশা) প্রদান করবে। তবে লন্ডন বৈঠকে সে সময় এগিয়ে আনার ব্যাপারে সায় দেন প্রধান উপদেষ্টা।
Sharing is caring!