
প্রজন্ম ডেস্ক:
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত আগস্টে দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত ১১টি দেশ সফর করেছেন। এর মধ্যে ৩টি দ্বিপক্ষীয় এবং বাকি ৮টি বহুপক্ষীয়। এসব সফরে তিনি ব্যক্তিগত ভাবমূর্তিকে কাজে লাগিয়ে দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছেন। তবে সর্বশেষ লন্ডনে দ্বিপক্ষীয় সফরে দেশটির প্রধানমন্ত্রীর সাক্ষাৎ না পাওয়ায় প্রধান উপদেষ্টাকে নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে।
প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে অংশ নিতে গত বছরের ২৩ থেকে ২৮ সেপ্টেম্বর যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক সফর করেন ড. ইউনূস। সরকারপ্রধান হিসেবে প্রথম এ সফরে তিনি যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে সাইডলাইনে বৈঠক করেন। বৈঠকটি সাম্প্রতিক সময়ের ইতিহাসে অনন্য। কারণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সাধারণত দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন না। কিন্তু অধ্যাপক ইউনূসের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। বৈঠকে তিনি ড. ইউনূসকে জড়িয়ে ধরার দৃশ্য সামাজিকমাধ্যমে ভাইরাল হয়। এ ছাড়া কানাডার প্রধানমন্ত্রী জাস্টিন ট্রুডো, ইতালির প্রধানমন্ত্রী জর্জিয়া মেলোনি, বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা, আইএমএফের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিভা, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শাহবাজ শরিফ, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংক্রান্ত হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক, ইউএনইউচসিআরের প্রধান ফিলিপো গ্রান্ডিসহ বেশ কয়েকজন বিশ্ব নেতার সঙ্গে বৈঠক করেন ড. ইউনূস। ক্লিনটন গ্লোবাল ইনিশিয়েটিভের মঞ্চেও বক্তব্য দেন ড. ইউনূস। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন নিজেও এ সময় উপস্থিত ছিলেন। এ সফরে ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন দার লিয়েনসহ আরও একাধিক বিশ্ব নেতাদের সঙ্গে বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা।
এ সফর প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল হক বলেন, নিউইয়র্কে জাতিসংঘ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টা যেসব বিশ্ব নেতার সঙ্গে বৈঠক করেছেন তা বাংলাদেশের জন্য ইতিবাচক। ওই মুহূর্তে বাংলাদেশ এক জটিল পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে যাচ্ছিল, তাই ওই বৈঠকগুলো ছিল ওই সময়ের জন্য বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ এবং স্বস্তির। ওই বৈঠকের কিছুদিন আগেও মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রসহ বিশ্ব সম্প্রদায়ের চাপে ছিল বাংলাদেশ। ওই সফরের পর বহির্বিশ্বে বাংলাদেশ সম্পর্কে ইতিবাচক ভাবই তৈরি হয়। তার চেয়েও বড় খবর গত ১৫ বছরেও বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের সঙ্গে বৈঠক করতে পারেনি। কিন্তু ড. ইউনূসের সরকার মাত্র দেড় মাসের মধ্যে তা করতে সমর্থ হয়।
জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সম্মেলনে অংশ নেওয়ার জন্য প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস গত বছরের নভেম্বরে আজারবাইজানের বাকু সফর করেন। এটি ছিল তার দ্বিতীয় বিদেশ সফর। এ সফরে জলবায়ু সম্মেলনের সাইডলাইনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট ও আরব আমিরাতের আমিরসহ ২০ জনেরও বেশি বিশ্বনেতা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
উন্নয়নশীল ৮ দেশের জোট ডি-৮ সম্মেলনে যোগ দিতে গত ১৮ থেকে ২০ ডিসেম্বর মিসরের কায়রো সফর করেন প্রধান উপদেষ্টা। এটি তৃতীয় বিদেশ সফর ছিল প্রধান উপদেষ্টার। ড. ইউনূস এ সফরে ১৯ ডিসেম্বর মিসরের রাজধানী কায়রোতে অনুষ্ঠিত ১১তম ডি-৮ সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন। সম্মেলনের আগে তিনি কায়রোতে নতুন প্রেসিডেন্ট প্রাসাদ পরিদর্শনে গেলে মিসরের প্রেসিডেন্ট আবদেল ফাত্তাহ আল-সিসি তাকে প্রাসাদে স্বাগত জানান। প্রধান উপদেষ্টা ‘গাজা ও লেবাননে মানবিক সংকট এবং পুনর্গঠন চ্যালেঞ্জ’ শীর্ষক সম্মেলনের একটি বিশেষ অধিবেশনে বক্তৃতা করেন। ডি-৮ সম্মেলনের সাইডলাইনে একটি হোটেলে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী শেহবাজ শরিফের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন ড. ইউনূস।
প্যালেস্টাইন লিবারেশন অর্গানাইজেশনের (পিএলও) মহাসচিব হুসেইন আল শেখ সম্মেলনের ফাঁকে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন। এ ছাড়াও সফরের সাইডলাইনে মালয়েশিয়ার উচ্চশিক্ষা মন্ত্রী ড. জাম্বরি আবদুল কাদির কায়রোর সেন্ট রেজিস হোটেলে ড. ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন।
প্রধান উপদেষ্টা বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে (ডব্লিউইএফ) যোগ দিতে গত ২১-২৪ জানুয়ারিতে সুইজারল্যান্ডের ডাভোস সফর করেন। এ ছিল তার চতুর্থ বিদেশ সফর। এ সফরে তিনি ডব্লিউইএফের ৪৭টি অনুষ্ঠানে যোগ দেন। এ সফরে প্রধান উপদেষ্টা চারজন সরকারপ্রধান/রাষ্ট্রপ্রধান, চারজন মন্ত্রী পর্যায়ের বিশিষ্ট ব্যক্তি, জাতিসংঘ/সদৃশ সংস্থার ১০ জন প্রধান বা শীর্ষ নির্বাহী, ১০ জন সিইও/উচ্চ পর্যায়ের ব্যবসায়ী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বৈঠকসহ বিভিন্ন অনুষ্ঠানে যোগ দেন এবং ৮টি মিডিয়ার সঙ্গে কথা বলেন।
সংযুক্ত আরব আমিরাতের উপরাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী এবং দুবাইয়ের শাসক মোহাম্মেদ বিন রশিদ আল মাখতুমের আমন্ত্রণে ওয়ার্ল্ড গভর্নমেন্ট সামিটে (ডব্লিউজিএস) অংশ নিতে প্রধান উপদেষ্টা গত ফেব্রুয়ারিতে সংযুক্ত আরব আমিরাত সফর করেন, যা তার পঞ্চম বিদেশ সফর। ডব্লিউজিএসে অংশগ্রহণের পাশাপাশি অধ্যাপক ড. ইউনূস সংযুক্ত আরব আমিরাতের স্বাস্থ্যমন্ত্রী আবদুর রহমান বিন মোহাম্মদ আল ওয়াইস, বাণিজ্যমন্ত্রী থানি বিন আহমেদ আল জেয়ৌদিসহ একাধিক মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করেন। বৈঠকগুলোতে তিনি পারস্পরিক স্বার্থ-সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন। এরমধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল, বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার, দ্বিপক্ষীয় ব্যবসা-বাণিজ্য সম্প্রসারণ, চট্টগ্রাম বন্দরে সংযুক্ত আরব আমিরাতের বিনিয়োগ পরিকল্পনা এবং ক্রীড়া ও শিক্ষার ক্ষেত্রে সম্পর্ক আরও গভীর করা। এ সফরে প্রধান উপদেষ্টা সংযুক্ত আরব আমিরাত কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশি নাগরিকদের ওপর ভিসা নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার এবং আরও বেশি বাংলাদেশি কর্মী নিয়োগের আহ্বান জানান। তিনি আমিরাতের কোম্পানিগুলোকে বাংলাদেশে তাদের কারখানা স্থানান্তরের আমন্ত্রণ জানান। এ ছাড়া সংযুক্ত আরব আমিরাতের বাণিজ্যমন্ত্রী সে দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য বাংলাদেশে একটি বিশেষ শিল্পপার্ক স্থাপনের প্রস্তাব দিলে প্রধান উপদেষ্টা এ ব্যাপারে নীতিগত সম্মতি দেন।
বোয়াও ফোরাম ফর এশিয়ায় অংশ নিতে প্রধান উপদেষ্টা গত মার্চে চীনের হাইনান এবং বেইজিং সফর করেন। এটি ছিল প্রধান উপদেষ্টার ষষ্ঠ বিদেশ সফর এবং প্রথম দ্বিপক্ষীয় এ সফরে দুদেশের মধ্যে একটি চুক্তি ও ৮টি সমঝোতা স্মারক সই হয়। চীন ২১০ কোটি ডলারের বিনিয়োগ ও ঋণ-অনুদানের প্রতিশ্রুতি দেয়। চীনের প্রায় ৩০টি প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে বিশেষ চীনা শিল্প অর্থনৈতিক অঞ্চলে ১০০ কোটি ডলার বিনিয়োগের অঙ্গীকার করে। সফরের যৌথ বিবরণীতে বলা হয়, এক চীন নীতির প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছে বাংলাদেশ। সেইসঙ্গে বাংলাদেশ বিশ্বাস করে যে, তাইওয়ান চীনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ। অন্যদিকে বাংলাদেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পানি সম্পদসহ উৎপাদনমুখী প্রতিষ্ঠান গড়া এবং রোহিঙ্গা সংকটের সমাধানে সহযোগিতা করবে চীন। দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কের বাইরে আঞ্চলিক এবং আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও বাংলাদেশের পাশে থাকবে দেশটি।
প্রধান উপদেষ্টর চীন সফর প্রসঙ্গে অধ্যাপক নুরুল আমিন বেপারি বলেন, প্রধান উপদেষ্টার চীন সফর ছিল অত্যন্ত সফল। এ সফরের মাধ্যমে বাংলাদেশের বেকার সমস্যা দূর হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র (ভারত) বাংলাদেশকে যে হুমকি দিচ্ছিল, ওই সফর ছিল সেই হুমকির জবাব। ড. ইউনূসের অন্তর্বর্তী সরকার যাতে টিকতে না পারে সেজন্য তারা (ভারত) এখনও ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশেরও যে ভালো বন্ধু আছে ওই সফরে ছিল তার প্রতিধ্বনি।
বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ‘বহুখাতীয়, কারিগরি ও অর্থনৈতিক সহযোগিতা উদ্যোগ (বিমসটেক)’ শীর্ষ সম্মেলনে যোগ দিতে প্রধান উপদেষ্টা গত এপ্রিলে থাইল্যান্ডের ব্যাংকক সফর করেন। সপ্তম এই বিদেশ সফরে বিমসটেকের ষষ্ঠ শীর্ষ সম্মেলনের সাইডলাইনে গত ৪ এপ্রিল দুপুরে ব্যাংককে অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ৪০ মিনিটের দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। বৈঠকে ঢাকার পক্ষ থেকে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফেরতসহ দ্বিপক্ষীয় সম্পর্কোন্নয়নে তাগাদা দেওয়া হয়। অন্যদিকে দিল্লির পক্ষ থেকে হাসিনা ইস্যুতে মন্তব্য না করে নোট নেওয়া হয় এবং দিল্লির পক্ষ থেকে বলা হয়, ভারত ভবিষ্যতে একটি গণতান্ত্রিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক, স্থিতিশীল বাংলাদেশ দেখতে চায়।
এ সফর প্রসঙ্গে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক অতিরিক্ত সচিব ও রাষ্ট্রদূত মো. মাহফুজুর রহমান বলেন, গত এপ্রিলে অনুষ্ঠিত ড. ইউনূস-মোদি বৈঠক বার্তা দেয় যে দুপক্ষের সম্পর্কে বরফ গলা শুরু হয়েছে। বৈঠকটি এমন সময়ে অনুষ্ঠিত হয় যাকে আমরা পরিপক্ব সময় বলতে পারি। বৈঠকে বাংলাদেশ শেখ হাসিনাকে ফেরতের বিষয়টি উপস্থাপন করেছে, যা উল্লেখযোগ্য এবং গুরুত্বপূর্ণ। ভারত এ বিষয়ে কী বলল বা বলল না, সেটা বিষয় না। মূল বিষয় হচ্ছে, বাংলাদেশ হাসিনাকে ফেরত চায় এবং তা ভারতকে জানান দেওয়া।
কাতারের আমির শেখ তামিম বিন হামাদ আল-সানির আমন্ত্রণে আর্থনা সম্মেলনে অংশ নিতে প্রধান উপদেষ্টা গত এপ্রিলে কাতারের দোহা সফর করেন, যা তার অষ্টম বিদেশ সফর। এ সফরে আর্থনা সম্মেলনে অংশ নেওয়ার পাশাপাশি কাতারের আমিরের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়। বৈঠকে বাংলাদেশ পুনর্গঠনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি সম্ভাব্য সব ধরনের সহায়তা দেওয়ার আশ্বাস দেন কাতারের প্রধানমন্ত্রী। তিনি প্রধান উপদেষ্টাকে জানান, বাংলাদেশের সঙ্গে কাতারের সম্পর্ককে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যেতে তার (কাতারের প্রধানমন্ত্রী) একজন ঘনিষ্ঠ সহযোগীকে মনোনীত করবেন। দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে বৈঠকে রোহিঙ্গা সংকট এবং গাজা পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনা হয়। পাশাপাশি ড. ইউনূস কাতার সফরে বাংলাদেশের নারী ক্রীড়াবিদদের প্রশিক্ষণ এবং সুযোগ-সুবিধা ও বাংলাদেশের মাদরাসা শিক্ষার্থীদের জন্য কাতারের সহায়তা কামনা করেন। প্রধান উপদেষ্টার কাতার সফরে জ্বালানি, বিনিয়োগ এবং প্রতিরক্ষা ইস্যুতে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত হয়।
গ্যাস সরবরাহ নিশ্চিত করতে এ সফরে কাতার বাংলাদেশকে আরও বেশি পরিমাণে এলএনজি দিতে সম্মত হয়। কাতারের কাছ থেকে এলএনজি আনা ইস্যুতে বাংলাদেশ বেশ কয়েকটি সমঝোতা স্মারক সই করে। এরমধ্যে গত জানুয়ারিতে একটি সমঝোতা স্মারকের মেয়াদ শেষ হয়। মেয়াদ উত্তীর্ণ সমঝোতা স্মারকটি নবায়ন করতে প্রধান উপদেষ্টার আহ্বানে রাজি হয় কাতার। এ ছাড়াও কাতার বিভিন্ন ক্ষেত্রে দায়িত্ব পালনের লক্ষ্যে বাংলাদেশ থেকে ৭২৫ জন সেনাসদস্য নেওয়ার কথা জানায়। এ সফরে প্রধান উপদেষ্টা কাতারের জন্য বাংলাদেশে একটি বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল প্রতিষ্ঠার ঘোষণা দেন। যেখানে কাতার সামরিক খাতের সরঞ্জাম তৈরির কারখানা স্থাপন করতে পারবে।
পোপ ফ্রান্সিসের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায় অংশ নিতে প্রধান উপদেষ্টা গত এপ্রিলে কাতার থেকে ভ্যাটিকান সিটি সফর করেন। এটি ছিল তার নবম বিদেশ সফর।
নিক্কেই ফোরাম ফিউচার অব এশিয়ায় অংশ নিতে প্রধান উপদেষ্টা গত মে মাসে জাপান সফর করেন। এটি ছিল প্রধান উপদেষ্টার দশম বিদেশ সফর ও দ্বিতীয় দ্বিপক্ষীয় সফর। এ সফরে প্রধান উপদেষ্টা জাপানের প্রধানমন্ত্রী শিগেরু ইশিবার সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন। দুপক্ষের শীর্ষ বৈঠকে সবার জন্য শান্তি, স্থিতিশীলতা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সমৃদ্ধি নিশ্চিত করতে বন্ধুপ্রতিম দুদেশ ইন্দো-প্যাসিফিক অঞ্চল ইস্যুতে তাদের সমর্থনের পুনরাবৃত্তি করেছে। এ সফরে জাপান ও বাংলাদেশ একটি চুক্তিপত্র বিনিময় করেছে, যার অধীনে টোকিও বাজেট সহায়তা, রেলপথ উন্নয়ন এবং অনুদান হিসেবে ঢাকাকে মোট ১ দশমিক ০৬৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার দিচ্ছে। দুই শীর্ষ নেতার মধ্যে বৈঠক শেষে ৯ দফাসংবলিত একটি যৌথবিবরণী প্রকাশ করা হয়। প্রধান উপদেষ্টার উপস্থিতিতে এ সফরে দুপক্ষের মধ্যে ৬টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) সই হয়। এগুলো হচ্ছে জ্বালানি খাতের প্রকল্প বাস্তবায়ন, অর্থনৈতিক অঞ্চলে জমি লিজ সংক্রান্ত সমঝোতা, গ্যাস মিটারের অ্যাসেম্বলি, ইন্সপেকশন ও রক্ষণাবেক্ষণ, কারখানা স্থাপন করার পরিকল্পনা, গার্মেন্ট এক্সেসরিজ উৎপাদনের পরিকল্পনা, ব্যাটারিচালিত বাইসাইকেল ও ইলেকট্রিক মোটরসাইকেল তৈরির কারখানা স্থাপন করা, তথ্য নিরাপত্তায় কিপার প্রযুক্তির পাইলট প্রকল্প শুরু, বাংলাদেশকে একটি কোয়ান্টাম-প্রতিরোধী ডিজিটাল অর্থনীতিতে রূপান্তর করা এবং বিদেশি বিনিয়োগের জন্য বিডার (বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ) সেবা কার্যক্রমকে এক ছাদের নিচে আনতে সহযোগিতা করবে জাপান। এ ছাড়া আগামী ৫ বছরে বাংলাদেশ থেকে কমপক্ষে ১ লাখ দক্ষকর্মী নেবে জাপান। প্রধান উপদেষ্টার জাপান সফরে এ বিষয়ে ঢাকা-টোকিওর মধ্যে দুটি এমওইউ সই হয়। একটি বাংলাদেশের জনশক্তি কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরো (বিএমইটি) ও জাপান-বাংলাদেশ যৌথ উদ্যোগে প্রতিষ্ঠিত কাইকম ড্রিম স্ট্রিটের (কেডিএস) মধ্যে সমাঝোতা, অন্যটি বিএমইটি ও জাপানের ন্যাশনাল বিজনেস সাপোর্ট কম্বাইন্ড কো-অপারেটিভসের (এনবিসিসি) এবং জেবিবিআরের (জাপান বাংলা ব্রিজ রিক্রুটিং এজেন্সি) মধ্যে।
এ সফর নিয়ে সাবেক রাষ্ট্রদূত মো. শহীদুল হক বলেন, জাপানের সফরটি ভালো হয়েছে। তবে এর আগে চীনের সফরটি আরও ভালো ছিল। এসব সফরে যেটা ভয় লাগে, যারা আমাদের স্বার্থ দেখে-যেমন চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্র-এসব দেশ সফরে ভালোর পাশাপাশি ঝুঁকিও রয়েছে। ঝুঁকিটা হচ্ছে-অনেক দেশ আবার মনে করে, বাংলাদেশ অন্যদিকে ঝুঁকে পড়ছে কি না, বিষয়গুলো এমন ধরনের। যা হোক, জাপান সফরে যে ৬টি সমঝোতা স্মারক সই হয়েছে, তা অত্যন্ত কাজের। তবে আমাদের এখন রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিতের প্রতি বেশি জোর দিতে হবে। কেননা আমরা নিজেরা শক্ত না হলে বা স্থিতিশীলতা নিশ্চিত না হলে জাপানের মতো বন্ধুরা ঝুঁকি নিয়ে আমাদের পাশে দাঁড়াবে না। স্বাধীনতার পর জাপান অন্যতম বন্ধুদেশ যারা অর্থনীতি, সড়ক ও সেতু উন্নয়নসহ নানাভাবে আমাদের সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে এবং এখনও করছে। এই সময়ে আমাদের বাজেট সমর্থন প্রয়োজন ছিল, যা জাপান দিচ্ছে।
সর্বশেষ চলতি জুনে প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাজ্য সফর করেন। এটি তার একাদশতম বিদেশ সফর এবং তৃতীয় দ্বিপক্ষীয় সফর। প্রধান উপদেষ্টার এ সফর নিয়ে দেশজুড়ে আলোচনা-সমালোচনা হচ্ছে। তার সদ্যসমাপ্ত যুক্তরাজ্য সফর বাংলাদেশ থেকে পাচার হওয়া অর্থ-সম্পদ দেশে ফেরাতে আগামীতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন বিশ্লেষকরা। দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে যে অস্বস্তি ছিল এ সফরে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারপারসনের সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকের পর সেখানে স্বস্তির বাতাস বইছে। এ সফরে অধ্যাপক ইউনূস ‘কিং চার্লস তৃতীয় হারমনি অ্যাওয়ার্ড ২০২৫’ সম্মাননা গ্রহণ করেন। সফরকালে ব্রিটিশ রাজা তৃতীয় চার্লসের সঙ্গেও একান্ত বৈঠক করেন ড. ইউনূস। এ ছাড়াও এ সফরে প্রধান উপদেষ্টা যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্সের স্পিকার ছাড়াও একাধিক গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির সঙ্গে বৈঠক করেন এবং বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশ নেন।
তবে প্রধান উপদেষ্টার এ সফর প্রসঙ্গে সাবেক রাষ্ট্রদূত মুন্সি ফায়েজ বলেন, প্রধান উপদেষ্টার যুক্তরাজ্য সফরটি চরমভাবে অব্যবস্থাপনায় ভরা ছিল। সফরটিকে দ্বিপক্ষীয় বলা হলেও সবকিছুতে অনিশ্চয়তা দেখেছি। সফরের কিছুই আগে থেকে ঠিক করা ছিল না, যা দেশের জন্য অসম্মানজনক। যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক ইস্যুতে প্রধান উপদেষ্টা বলেছেন, ‘বার বার চেষ্টা করছি কিন্তু পারছি না।’ সেখানে যদি তাদের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকই না হয় তবে তিনি কেন গেলেন? এটা সম্মানজনক নয়। এ সফরে একটাই সাফল্য-বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের সঙ্গে বৈঠকের পর অস্বস্তিকর রাজনীতিতে স্বস্তি ফিরেছে। কিন্তু এ বৈঠকের জন্য কি প্রধান উপদেষ্টাকে লন্ডন যেতে হবে? এ সফরের অনেক কিছুই গোপন ছিল এবং স্বচ্ছতা ছিল না। আর অর্থ ফেরত আনা প্রধান উপদেষ্টার কাজ নয়। এ দায়িত্ব পালন করা যার কাজ তিনি গেলেই হতো। লন্ডনের বিমানবন্দরেও প্রধান উপদেষ্টাকে যথাযথভাবে প্রটোকল দেওয়া হয়নি। নিজেদের ঘর না গুছিয়ে, ঘন ঘন বিদেশ সফর করে পৃথিবী পরিবর্তন করা আর তিন শূন্য দিয়ে বক্তৃতা দেওয়া প্রধান উপদেষ্টার কাজ নয়। আবার গুরুত্বপূর্ণ এ সফরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েরও কেউ ছিলেন না।
Sharing is caring!