
প্রজন্ম ডেস্ক:
বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বর্তমানে বসবাস করছেন প্রায় দুই কোটি বাংলাদেশি। আগামী ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তাদের ভোট দেওয়ার সুযোগ সৃষ্টিতে নানামুখী তৎপরতা চালাচ্ছে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রবাসীদের ভোটার করে তাদের নাগরিক সনদ প্রদানেও সংস্থাটির পক্ষ থেকে তৎপরতা বাড়ানো হয়েছে। এ পর্যায়ে মাত্র সাতটি দেশে প্রবাসীদের ভোটার করার কার্যক্রম চললেও গত ৮ জানুয়ারি আরও ৪০টি দেশের তথ্য চেয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে চিঠি দেওয়া হয়েছে। তবে সংকট দেখা দিয়েছে ভোট প্রদানের পদ্ধতি কী হবে, তা নিয়ে।
নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, প্রবাসীদের ভোট যে পদ্ধতিতেই নেওয়া হোক না কেন, গণপ্রতিনিধিত্ব অধ্যাদেশে (আরপিও) পরিবর্তন আনা ছাড়া সেটা বাস্তবায়ন সম্ভব না। বিদ্যমান আইনি বাধা দূর করে আগামী সংসদ নির্বাচন থেকেই এ ব্যবস্থা চালু করতে চায় নির্বাচন কমিশন।
প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে জটিলতা নিরসনের সহজ ও গ্রহণযোগ্য উপায় খুঁজতে চলছে এ-সংক্রান্ত বিভিন্ন দেশের তথ্য-উপাত্ত পর্যবেক্ষণ ও পর্যালোচনা। এ বিষয়ে গত ১৫ জানুয়ারি প্রকাশিত নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশেও প্রবাসীদের ভোটাধিকারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। তাতে প্রবাসীদের ভোটের জন্য দুটি উপায় তুলে ধরা হয়েছে- পোস্টাল ব্যালট ও অনলাইন ভোটিং পদ্ধতি। এসব বিষয়ে কমিশনের বিশ্লেষণও তুলে ধরা হয়েছে।
প্রবাসী রেমিট্যান্স-যোদ্ধাদের ভোটের গ্রহণযোগ্য উপায় খুঁজতে গঠিত হয়েছে ইসির কমিটি-উপকমিটি। গত ৩০ জানুয়ারি অনুষ্ঠিত ইসির তৃতীয় কমিশন সভা শেষে ইসি আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, এ বিষয়ে ইসির সংশ্লিষ্ট কমিটির পর্যালোচনায় এসেছে তিনটি সম্ভাব্য পদ্ধতি- পোস্টাল ব্যালট, প্রক্সি ভোটিং ও অনলাইন ভোট। এসবের মধ্যে পোস্টাল ব্যালট খুব একটা কার্যকরী নয়। প্রক্সি ভোটিংয়ের বিধান বিভিন্ন দেশে আছে। আর অনলাইন ভোটিং ব্যবস্থাটিও খুব সহজ নয়। তারা প্রথম দুটিকে অগ্রাধিকারে রেখেছেন। পাশাপাশি তিন নম্বর অপশন (অনলাইন ভোটিং) নিয়ে ফিচার ডেভেলপ করা এবং এটার গ্রহণযোগ্যতা যাচাইয়ে পাইলটিং করে তারা দেখতে চান। কারণ এ বিষয়ে সব পক্ষের সম্মত হওয়ার ব্যাপার রয়েছে। প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিদ্যমান আইনি বাধা দূর করা এবং এনআইডি সেবা সহজীকরণের উদ্যোগ নিয়েছে সংস্থাটি।
প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করতে আদালতের নির্দেশ বাস্তবায়নে বিগত আওয়ামী লীগ সরকারও অন্তত ছয়বার ঘোষণা দিয়েছিল। কিন্তু তা বাস্তবায়নের বদলে কিছু উদ্যোগের মাঝেই সীমাবদ্ধ ছিল ইসির কার্যক্রম। এবারও নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রবাসীর ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে। কিন্তু বিশ্লেষকদের তথ্য অনুযায়ী, এ বিষয়ে আইন সংশোধন এবং কোন উপায়ে বা পদ্ধতিতে নেওয়া ভোট সর্বাধিক বিশ্বাসযোগ্য হবে, তা নিয়ে এখনো তাদের অবস্থান বিশ্লেষণের টেবিলে।
এ বিষয়ে করা সুপারিশ সম্পর্কে জানতে কথা হয় নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সদস্য এবং ইলেকট্রনিক ভোটিং (ই-ভোটিং) ও ব্লকচেইন বিশেষজ্ঞ ড. মোহাম্মদ সাদেক ফেরদৌসের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করার বিষয়ে আমরা প্রবাসীদের সঙ্গে অনলাইনে মতবিনিময় করেছি। তাতে সরাসরি দেশে গিয়ে ভোট দেওয়া, প্রক্সি ভোটিং, অনলাইন ভোটিং ও পোস্টাল ভোটিং- এই চার পদ্ধতির ভোট নিয়ে আলোচনা হয়। প্রবাসীদের ভোটের বিষয়টি আইনে না থাকায় যে পদ্ধতিতেই ভোট নেওয়া হোক না কেন, তা বাস্তবায়নে আরপিওতে পরিবর্তন আনার বিকল্প নেই। সংস্কার কমিশনের খসড়া প্রতিবেদনে পোস্টাল ব্যালটকে বিশ্বাসযোগ্য করতে ব্লকচেইন পদ্ধতির কথা উল্লেখ করা হয়। এই পদ্ধতিটি প্রাথমিক পর্যায়ে একটি দেশে ট্রায়ালের কথা রয়েছে। যেখানে প্রায় ৫০ থেকে ১০০ জন প্রবাসী ভোটার অংশ নেবেন। পরবর্তী সময়ে এটি ৫ থেকে ১০টি দেশে এক থেকে পাঁচ হাজার প্রবাসী ভোটারের মধ্যে এবং শেষ পর্যায়ে সিস্টেমটি যত বেশি সম্ভব দেশে ২০ হাজার বা তার বেশি প্রবাসী ভোটারদের মধ্যে ট্রায়ালের ব্যবস্থা করার পরামর্শ রয়েছে।
বিদ্যমান আরপিও অনুযায়ী, বাংলাদেশি ভোটারদের দুভাবে- সরাসরি ভোট ও পোস্টাল ব্যালটে ভোট দেওয়ার কথা উল্লেখ রয়েছে। আর পোস্টাল ভোটিংও প্রবাসীদের জন্য নয়, সেটি মূলত দেশের সেসব নাগরিকের জন্য, যারা ভোটের দিন তাদের নির্ধারিত ভোটকেন্দ্রে উপস্থিত হতে পারবেন না। পোস্টাল ব্যালটে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর ১৫ দিনের মধ্যে ভোটারকে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে ব্যালট পেপারের জন্য আবেদন করতে হয়। প্রার্থীদের প্রতীক বরাদ্দের পর ডাকঘরের মাধ্যমে ব্যালট পেপার আবেদনকারী ভোটারের কাছে পৌঁছানো হয়। তিনি ভোট দিয়ে সিলগালা করে ব্যালট ডাকঘরের মাধ্যমে নির্বাচনের দিন ভোট গ্রহণ শেষ হওয়ার আগে সংশ্লিষ্ট রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পাঠান।’
নির্বাচন কমিশনার রফিকুল ইসলামের মতে, পোস্টাল ব্যালট পদ্ধতি বেশ সময়সাপেক্ষ এবং খুব বেশি কার্যকর দেখা যায়নি। তিনি বলেন, ‘আইনে থাকায় প্রতিটি জাতীয় নির্বাচনের আগেই এটি ছাপানো হয় এবং রিটার্নিং কর্মকর্তাদের কাছে পাঠানো হয়। এর চ্যালেঞ্জিং বিষয় হলো- ভোটারকে অবশ্যই তার ভোটার এলাকা ও ভোটার নম্বরটি জানতে হবে এবং ভোটের দিন বিকেল ৪টার মধ্যে রিটার্নিং কর্মকর্তার কাছে পৌঁছাতে হবে। তা হলেই তার ভোট গণনার আওতায় আসবে। কেউ পোস্টাল ব্যালটে ভোট দিতে চাইলে তাকেও সচেতন হতে হবে। পোস্টাল ব্যালটে খুব নগণ্যসংখ্যক ভোট আসে। নতুন কোনো নিরাপদ প্রযুক্তি যুক্ত না করে পুরোনো ব্যবস্থায় ওই পদ্ধতির ভোট কার্যকর হবে না। তবে ইলেকট্রনিক ভোটিং সিস্টেম চালু করে ইলেকট্রনিক ব্যালটকে আইনি বৈধতা দেওয়া গেলে সহজতম পদ্ধতিতে ই-ভোট করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে এ দেশের ইন্টারনেটব্যবস্থার পুরোটিই প্রাইভেট সিস্টেম। তাই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা একেবারেই অসম্ভব।
দেশের উচ্চ আদালত ১৯৯৮ সালে প্রবাসী বাংলাদেশিদের ভোটাধিকার সংবিধান স্বীকৃত বলে ঘোষণা দেন। দীর্ঘ ২৬ বছরেও সেই ঘোষণা বাস্তবায়নের মুখ দেখেনি। ইসির জাতীয় পরিচয়পত্র নিবন্ধন অনুবিভাগের পরিচালক (নিবন্ধন ও প্রবাসী) মো. আবদুল মমিন সরকার বলেন, ‘২০২৩ সালের জুলাই থেকে এখন পর্যন্ত মাত্র সাতটি দেশের প্রবাসীরা ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত হতে পেরেছেন। সেগুলো হলো কুয়েত, কাতার, সংযুক্ত আরব আমিরাত, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, ইতালি ও ইউকে। এসব দেশে ১৪ হাজার প্রবাসী ভোটার হয়েছেন। তাদের মধ্যে সাড়ে আট হাজার প্রবাসীর হাতে পৌঁছেছে স্মার্ট কার্ড। এরপর মার্চের মধ্যে অস্ট্রেলিয়া ও কানাডায় ভোটার নিবন্ধন কার্যক্রম চালু করতে ইসির প্রস্তুতি চলছে। প্রবাসী-অধ্যুষিত নর্থ আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপসহ এশিয়ার অন্যান্য দেশে ভোটের প্রচলন রয়েছে। তার মধ্যে যেসব দেশের মানুষ বেশি প্রবাসে অবস্থান করেন, সেসব দেশ ভোটিং সিস্টেমে কীভাবে ভিন দেশে অবস্থানকারী নাগরিককে অন্তর্ভুক্ত রেখেছে আমরা সেগুলো বিশ্লেষণ করছি। তাদের ভোটিং সিস্টেম খতিয়ে দেখছি। সম্প্রতি তুরস্কে এ ধরনের একটি নির্বাচন হয়েছে, যেখানে প্রবাসীরা ভোট দিয়েছেন। ওই ধরনের সিস্টেম আমাদের দেশের নির্বাচনব্যবস্থায় বাস্তবায়ন করতে গেলে কূটনীতিক ও টেকনোলজিক্যাল যেসব সাপোর্ট প্রয়োজন হবে, সেগুলো দেখা হচ্ছে।’
ইসির এনআইডি শাখার মহাপরিচালক এ এস এম হুমায়ুন কবীর বলেছেন, ‘কমিশন প্রবাসীদের ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় আন্তরিক। এ পর্যায়ে বিদ্যমান আইনি কাঠামো, আইনি কোনো বাধা আছে কি না, তা সহ নানা দিক পর্যালোচনা করছে ইসির কমিটি। তবে এখনো চূড়ান্ত হয়নি। ভারত, ইউরোপ-আমেরিকাসহ বিভিন্ন দেশে প্রবাসে বসবাসকারীদের তারা কীভাবে ভোটে যুক্ত করতে পেরেছেন এবং সাইবার অ্যাটাকের ঝুঁকিসহ প্রযুক্তিগত খোঁজখবর নিচ্ছি। সে ক্ষেত্রে কোন প্রক্রিয়ায়, কীভাবে সেটা করা সম্ভব সব ধরনের তথ্য সংগ্রহ, আলোচনা ও পর্যালোচনা চলছে। বিভিন্ন দেশের সময়ের সঙ্গে আমাদের সময়ের পার্থক্যও বিবেচ্য বিষয়। কারণ ভোটের ব্যবস্থা করলেই হবে না, সেই ভোটের প্রক্রিয়াকে আন্তর্জাতিকভাবে বিশ্বাসযোগ্য করা সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ মনে করছি।’
প্রবাসীদের সংবিধান স্বীকৃত ভোটাধিকার প্রতিষ্ঠায় বিগত কমিশনগুলোর কার্যক্রম বিশ্লেষণে দেখা যায়, ২০১৯ সালের ১৮ নভেম্বর কে এম নূরুল হুদার নেতৃত্বাধীন কমিশন সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রবাসীদের মাঝে প্রথম এনআইডি সরবরাহ কার্যক্রম শুরু করে। তার আগে একই বছরের ৫ নভেম্বর মালয়েশিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশিদের ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্তি এবং স্মার্ট জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়ার অংশ হিসেবে অনলাইনে আবেদন নেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করা হয়। ২০২০ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি যুক্তরাজ্যপ্রবাসী বাংলাদেশিদের অনলাইনে ভোটার করে নেওয়ার কার্যক্রম উদ্বোধন করে ইসি। এরপর সৌদি আরব, সিঙ্গাপুর ও মালদ্বীপে থাকা বাংলাদেশিদের জন্যও এ সুযোগ চালু করা হয়। সে সময় অনলাইনে আবেদন নিয়ে সেই আবেদন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির উপজেলা থেকে যাচাই করে সত্যতা পেলে সংশ্লিষ্ট দেশের দূতাবাস থেকে এনআইডি সরবরাহের পরিকল্পনা ছিল। এরপর করোনা মহামারির কারণে থমকে যায় দূতাবাসের মাধ্যমে এ কার্যক্রম শুরুর পরিকল্পনা। সর্বশেষ কাজী হাবিবুল আউয়াল কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর সেই কার্যক্রমকে ফের উজ্জীবিত করে। এ ক্ষেত্রে আগের আবেদনগুলো পাশ কাটিয়ে তারা নতুন করে কার্যক্রম শুরু করে।
Sharing is caring!