প্রজন্ম ডেস্ক:
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ‘জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দেওয়া ভোলার জেলা প্রশাসক (ডিসি) আজাদ জাহানকে গাজীপুরের ডিসি পদে বদলি করেছে সরকার। বঙ্গবন্ধু ও শেখ হাসিনা পরিবারের সদস্যদের একাধিক ছবি ও ভিডিও পোস্ট করা আওয়ামী-ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তা আফসানা বিলকিসকে মাদারীপুরের ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। উপসচিব পদে পদোন্নতি পেয়েই বঙ্গবন্ধুর মাজারে ফুল দিয়ে শপথ নেওয়া নড়াইলের ডিসি শারমিন আক্তার জাহানকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ডিসি হিসেবে বদলি করা হয়েছে।
শুধু আজাদ জাহান, আফসানা বিলকিস কিংবা শারমিন আক্তার জাহানই নন, অনুসন্ধান বলছে—নির্বাচনকালীন মাঠ প্রশাসনের দায়িত্ব পেয়েছেন ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী অন্তত ১০ কর্মকর্তা।
পাশাপাশি মাঠ প্রশাসনে অভিজ্ঞতা না থাকা অন্তত তিন কর্মকর্তাকে ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। এতে একদিকে যেমন নির্বাচনকালীন মাঠ প্রশাসনে বড় ঝুঁকির শঙ্কা রয়েছে, তেমনি যোগ্য ও বঞ্চিত কর্মকর্তাদের বঞ্চনার ভার আরো বাড়ছে। গত ৮ ও ৯ নভেম্বর দুটি আলাদা প্রজ্ঞাপনে এসব ডিসিকে পদায়ন করে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়।
প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আওয়ামী-ঘনিষ্ঠ ও সুবিধাভোগীরা ডিসির দায়িত্ব পেলে জনগণের আস্থা নষ্ট হবে এবং প্রশাসন বিভক্ত হয়ে পড়বে।
এর প্রভাব পড়বে নির্বাচনের সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার ওপরও। এর আগে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সাবেক সিনিয়র সচিব মোখলেস উর রহমান দায়িত্ব গ্রহণের পর ডিসি পদায়নে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগ ওঠে জনপ্রশাসনসচিব ও তাঁর অনুগামী কয়েকজন ঘনিষ্ঠ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। ডিসি নিয়োগে তখন বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে ক্ষোভ জেগে ওঠে। বঞ্চিত কর্মকর্তাদের অনেকে জনপ্রশাসনসচিবকে ঘেরাও করেন।
সেই থেকে ডিসি নিয়োগে যে বিতর্ক শুরু হয়, তা বারবার ফিরে আসছে।
সম্প্রতি আসন্ন জাতীয় নির্বাচন ঘিরে ২৯ জেলায় যে জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, এতে আর্থিক কেলেঙ্কারির চিত্র না উঠলেও বেশির ভাগ আওয়ামীপন্থী আমলাকে নির্বাচনের আগে মাঠ প্রশাসনের দায়িত্ব দেওয়ায় জনপ্রশাসনের এই বিতর্ক আবার জোরালো হয়ে উঠেছে।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভোলার ডিসি আজাদ জাহানকে গাজীপুরের ডিসি পদে বদলি করা হয়। ফ্যাসিস্ট আমলে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করা এই কর্মকর্তার একাধিক ভিডিও ফুটেজ থেকে দেখা গেছে, তিনি পঞ্চগড়ের সাবেক ডিসি জহুরুল ইসলামের সঙ্গে ‘জয় বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু’ স্লোগান দিচ্ছেন।
অনুসন্ধান বলছে, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তা নিজ জেলা ঝিনাইদহের হরিণাকুণ্ডুতে প্রায় ৩০০ একর জমিতে দুর্নীতির টাকা দিয়ে মৎস্যঘের তৈরি করেছেন।
তবু এই আওয়ামী সুবিধাভোগী কর্মকর্তাকে ভোলা জেলার পর আবার গাজীপুরের মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি জেলার নির্বাচনকালীন ডিসির দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। এ নিয়ে অনেকে একদিকে যেমন নির্বাচন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছেন, তেমনি আওয়ামী সুবিধাভোগী হওয়ার পরও তাঁর এমন আশ্চর্য পদায়নে অসন্তোষ তৈরি হয়েছে প্রশাসনেও।
খাগড়াছড়ির স্থানীয় সরকারের উপপরিচালক (ডিডিএলজি) নাজমুন আরা সুলতানা মানিকগঞ্জের ডিসি হিসেবে নিয়োগ পেয়েছেন। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, তিনি বঙ্গবন্ধুর ম্যুরাল এবং ফজিলাতুন নেছা মুজিবের ম্যুরালে একাধিক ছবি তুলেছেন। হাতে আসা তথ্য-প্রমাণে খাগড়াছড়ির ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের সঙ্গেও তাঁর ঘনিষ্ঠ যোগাযোগের প্রমাণ মিলেছে। তিনি বিলুপ্ত ইকোনমিক ক্যাডার কর্মকর্তা।
একইভাবে কৃষি মন্ত্রণালয়ের উপসচিব সাইফুর রহমানকে ময়মনসিংহের ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। তিনিও বিলুপ্ত ইকোনমিক ক্যাডারের কর্মকর্তা। তাঁদের দুজনেরই মাঠ প্রশাসনে উল্লেখযোগ্য অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও ডিসি পদে পদায়ন করা হয়েছে। অথচ এ নিয়োগের ক্ষেত্রে একদিকে যেমন মাঠ প্রশাসনের দায়িত্ব পালনের অভিজ্ঞতার বাধ্যবাধকতা রয়েছে, অন্যদিকে যোগ্য ও বিচক্ষণ কর্মকর্তা হওয়াও প্রয়োজন।
গত ১৫ অক্টোবর আর্থিক প্রতিষ্ঠান বিভাগের উপসচিব আফসানা বিলকিসকে মাদারীপুরের ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়। আওয়ামী সরকারের সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তার সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের একাধিক দলীয় পোস্টের প্রমাণ এসেছে প্রতিবেদকের হাতে।
একাধিক তথ্যচিত্রে দেখা গেছে, সরকারি কর্মকর্তা হয়েও তিনি আওয়ামী লীগের এবং বঙ্গবন্ধুর জন্মবার্ষিকীসহ হাসিনা পরিবারের সদস্যদের ছবি নিজের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে শেয়ার করেছেন। বিভিন্ন সময়ে নিজের ফেসবুকে শেয়ার দিয়েছেন শেখ হাসিনা, শেখ মুজিব, শেখ রেহানার মেয়ে টিউলিপ রেজওয়ানাসহ অনেকের ছবি।
সাবেক মন্ত্রিপরিষদসচিব কবির বিন আনোয়ার ও জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের শায়লা ফারজানার ছবিও তিনি শেয়ার দিয়েছেন। আওয়ামী-ঘনিষ্ঠ এই কর্মকর্তাকে ডিসি হিসেবে পদায়ন করায় বিতর্ক শুরু হয়েছে প্রশাসনের ভেতরে-বাইরে।
নড়াইলের ডিসি শারমিন আক্তার জাহানকে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার একই পদে পদায়ন করা হয়েছে। বিসিএস ২৫ ব্যাচের এই কর্মকর্তা উপসচিব পদে পদোন্নতির পরই তাঁর নেতৃত্বে শেখ মুজিবুর রহমানের মাজারে ফুল দিতে যান কয়েকজন আওয়ামীপন্থী কর্মকর্তা। আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষে কাজ করার জন্য বঙ্গবন্ধুর মাজারকে সামনে রেখে শপথ নেওয়া অঙ্গীকারবদ্ধ এই কর্মকর্তাকে পর পর দুই জেলার ডিসির দায়িত্ব দেওয়ায় প্রশাসনের বঞ্চিত কর্মকর্তাদের মধ্যে আবারও অস্থিরতা শুরু হয়েছে। আওয়ামী সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তা নড়াইলে দায়িত্ব পালনকালে নানা আর্থিক অনিয়ম এবং কয়েকজনকে ভুয়া মুক্তিযোদ্ধা করায় খবরের শিরোনাম হন।
চট্টগ্রামের ডিসি পদে বদলি করা হয়েছে ফেনীর ডিসি সাইফুল ইসলামকে। তিনি আওয়ামী শাসনামলে অর্থ বিভাগ, বাগেরহাট ও মুন্সীগঞ্জের এডিসি এবং একই জেলার সিনিয়র সহকারী কমিশনারসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্টেশনে কাজ করেছেন। আওয়ামী সুবিধাভোগী এই কর্মকর্তা ফেনীর ডিসি হিসেবে যোগদান করেই এক আওয়ামী লীগ নেতার সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হন। তাঁর এই আশ্চর্য পদায়ন নিয়েও উঠেছে নানা বিতর্ক।
বাগেরহাটের ডিসি আহমেদ কামরুল হাসানকে নোয়াখালীর ডিসি পদে পদায়ন করা হয়েছে। এই কর্মকর্তা ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের অন্যতম সুবিধাভোগী কর্মকর্তা। ২০০৯ সাল থেকে বর্তমান সময় পর্যন্ত জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় ও মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে কর্মরত ছিলেন। মাঠ প্রশাসনে কাজের পর্যাপ্ত অভিজ্ঞতা না থাকা সত্ত্বেও তিনি দুই জেলার ডিসির দায়িত্ব পান।
সাবেক জনপ্রশাসনসচিব মোখলেস উর রহমানের সময়ে করা ডিসি ফিটলিস্ট থেকে বিসিএস ২৫তম ব্যাচের কর্মকর্তা সন্দ্বীপ কুমার সিংহকে বরগুনার ডিসি হিসেবে পদায়ন করা হয়েছে। তিনি আওয়ামী লীগ আমলে ২০১৮ সালে উপসচিব পদে পদোন্নতি পান। ২০১৪ সালের বিতর্কিত নির্বাচনের সময় তিনি আশুগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে সহকারী রিটার্নিং অফিসার (এআরও) ছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক) মামলা চলমান।
মেহেরপুরের ডিসি হিসেবে পদায়ন পাওয়া স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মিজ লুত্ফুন নাহার ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে এআরও ছিলেন। নির্বাচনের আগে ঢালাওভাবে আওয়ামী সুবিধাভোগীদের এই নিয়োগ নিয়ে প্রশাসনের ভেতরে-বাইরে শুরু হয়েছে নানা বিতর্ক।
সাবেক সচিব ও জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ আব্দুল আউয়াল মজুমদার বলেন, ডিসি পদে নিয়োগের ক্ষেত্রে রাজনৈতিক আনুগত্যকে প্রাধান্য দিলে প্রশাসনের নিরপেক্ষতা নষ্ট হয়—এটাই সবচেয়ে বড় বিপদ। নির্বাচনকালীন ডিসিরা মাঠ প্রশাসনের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে কাজ করেন। তাঁদের নিরপেক্ষ ও পেশাদার আচরণের ওপরই নির্ভর করে নির্বাচনী পরিবেশের স্বচ্ছতা ও শান্তি। কিন্তু যদি দেখা যায়, আওয়ামী সুবিধাভোগীরা ও অদক্ষ কর্মকর্তারাই দায়িত্ব পাচ্ছেন, তাহলে জনগণের আস্থা নষ্ট হবে এবং প্রশাসন বিভক্ত হয়ে পড়বে। এর প্রভাব পড়বে নির্বাচনের সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার ওপরও। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়কে এখনই এ ধরনের নিয়োগপ্রক্রিয়া পুনর্বিবেচনা করা উচিত। রাজনৈতিক সংশ্লিষ্টতা ছাড়াই মাঠ প্রশাসনে যাঁরা দীর্ঘদিন কাজ করেছেন এবং দক্ষতার প্রমাণ রেখেছেন, তাঁদেরই অগ্রাধিকার দেওয়া প্রয়োজন।
Sharing is caring!