প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৬ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

পেঁয়াজ-সিন্ডিকেট এক মাসে হাতিয়ে নিয়েছে হাজার কোটি টাকা

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ১৬, ২০২৫, ০৯:৩৮ পূর্বাহ্ণ
পেঁয়াজ-সিন্ডিকেট এক মাসে হাতিয়ে নিয়েছে হাজার কোটি টাকা

Manual8 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

গত এক মাসে ব্যবসায়ী নামধারী অসাধু চক্র পেঁয়াজের বাজারে কারসাজি করে বাজার থেকে হাতিয়ে নিয়েছে হাজার কোটি টাকা। এ চক্রে আছেন প্রভাবশালী ব্যক্তিরা। তারা শুধু পেঁয়াজ না, বিভিন্ন পণ্য নিয়ে চাহিদা-সরবরাহ-দামের কারসাজি করে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন।

দেশের বিভিন্ন বাজারে খোঁজ নিয়ে এবং সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের তদন্ত প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করে এমন তথ্য মিলেছে।

Manual4 Ad Code

বাজারে পেঁয়াজের দর বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, অক্টোবরের মাঝামাঝি পেঁয়াজের দর বাড়া শুরু করে। ১৭ থেকে ৩০ অক্টোবর ১৪ দিনে প্রতি কেজি পেঁয়াজ গড়ে ২০-২২ টাকা করে বেড়েছে। এই কদিনে দাম বাড়ানোর কারণে সিন্ডিকেট হাতিয়ে নিয়েছে ২৫২ কোটি টাকা।

গত ৩১ অক্টোবর থেকে ৫ নভেম্বর পর্যন্ত পণ্যটির দাম প্রতি কেজি গড়ে ৩৫-৩৬ টাকা করে বেড়েছে। এই ছয় দিনে দাম বাড়ানোর কারণে সিন্ডিকেটের পকেটে গেছে ১৮৯ কোটি টাকা।

৬ নভেম্বর থেকে পেঁয়াজের দাম আরও বাড়ানো হয়েছে। প্রতি কেজি গড়ে ৬০-৬৫ করে বেড়েছে, যা এখনো অব্যাহত আছে। ৬ নভেম্বর থেকে গতকাল (১৫ নভেম্বর) ১০ দিনে অতিরিক্ত দাম বাড়িয়ে ৫৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে অসাধু চক্র। এভাবে তিন ধাপে অসাধু পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের পকেটে গেছে মোট ৯৮১ কোটি টাকা।

 

প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সিন্ডিকেট করেই পেঁয়াজের দাম বাড়ানো হয়েছে। সাধারণ মানুষ এসব সিন্ডিকেটের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছে। পুরোনো সিন্ডিকেট নতুন চেহারা নিয়েও হাজির হয়েছে। এসব সিন্ডিকেটে নতুনভাবে অসাধু ব্যক্তিরাও যোগ হয়েছেন। এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেওয়াটা জরুরি।

সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি)-এর বিশিষ্ট ফেলো অধ্যাপক ড. মুস্তাফিজুর রহমান বলেন, এসব শক্তিশালী সিন্ডিকেট বছরের পর বছর সাধারণ মানুষকে জিম্মি করে পণ্যের দাম বাড়িয়েছে। তারা সরকারের কিছু অসাধু ব্যক্তিকে এসব সিন্ডিকেট চালিয়ে নিতে অনৈতিক সুবিধা দিয়ে থাকে। এদের আটকাতে হবে। সিন্ডিকেট ভেঙে দিতে হবে।

কৃষি মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘দেশে পেঁয়াজের ঘাটতি নেই। চলতি মাসেই বাজারে এসেছে অন্তত ৭৫ হাজার টন নতুন দেশি পেঁয়াজ। তার পরও বাজারে পেঁয়াজের দর বেড়েছে। মধ্যস্বত্বভোগীদের সরাসরি কারসাজি এ জন্য দায়ী।’

 

Manual1 Ad Code

 

ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) সর্বশেষ প্রতিবেদনেও পেঁয়াজের দর বাড়ার পেছনে ব্যবসায়ীদের কারসাজির কথা উঠে এসেছে।

Manual2 Ad Code

বিটিটিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ‘পেঁয়াজের উচ্চ দামের সুবিধা কৃষক পাচ্ছেন না। মধ্যস্বত্বভোগীরা এ সুযোগ নিচ্ছেন। বাজারে মধ্যস্বত্বভোগীদের প্রভাব কমানো সম্ভব হলে ভোক্তারা যৌক্তিক মূল্যে পেঁয়াজ কিনতে পারবেন।’

বাংলাদেশের পেঁয়াজ আমদানির প্রধান উৎস দেশ ভারত। ভারত থেকে পেঁয়াজের মোট আমদানির ৯৯ শতাংশই করা হয়। এ ছাড়া তুরস্ক, পাকিস্তান, মায়ানমার, চীন ও মিসর থেকেও পেঁয়াজ আমদানি হয়। গত অর্থবছরে মোট ৪ লাখ ৮৩ হাজার টন পেঁয়াজ আমদানি হয়। বর্তমানে পেঁয়াজের ওপর মোট ১০ শতাংশ শুল্ককর প্রযোজ্য। এখন পেঁয়াজ আমদানি বন্ধ রেখেছে সরকার।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, নতুন পেঁয়াজ উঠলে বাজারে সংকট থাকবে না। দামও কমবে।

এদিকে গত অর্থবছরে দেশে ৪৪ লাখ ৪৮ হাজার টন পেঁয়াজ উৎপাদন হয়েছে। তবে সংরক্ষণ সমস্যাসহ নানা কারণে পেঁয়াজ নষ্ট হয়। তাই গত অর্থবছরে ৩৩ লাখ টনের মতো পেঁয়াজ বাজারে এসেছে। কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের তথ্যমতে, বাংলাদেশ পেঁয়াজের বার্ষিক চাহিদা ৩৫ থেকে ৩৬ লাখ টন। উৎপাদন হয় ৩২ থেকে ৩৩ লাখ টন। দেশে দৈনিক ৯ হাজার টনের মতো পেঁয়াজের চাহিদা আছে।

 

সংরক্ষণ ব্যবস্থার দুর্বলতার কারণে উৎপাদন করা পেঁয়াজের প্রায় ২৫-৩০ শতাংশ নষ্ট হয়ে যায়। এতে চাহিদা মেটাতে প্রতিবছর উল্লেখযোগ্য পরিমাণে পেঁয়াজ আমদানি করতে হয়। চাহিদা মেটানোর জন্য প্রতিবছর গড়ে ৭ থেকে ১০ লাখ মেট্রিক টন পেঁয়াজ আমদানি করার প্রয়োজন হয়।

চট্টগ্রামের ব্যুরোপ্রধান ইফতেখারুল ইসলামের দেওয়া তথ্যমতে, এক মাসে চট্টগ্রামের দুই পাইকারি বাজার থেকে শুধু পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে ৪০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে সিন্ডিকেট। চট্টগ্রামের অন্যতম পাইকারি বাজার চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জের কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর সঙ্গে সীমান্তর্বর্তী কিছু আমদানিকারকের যোগসাজশে পেঁয়াজের দাম বাড়িয়ে ক্রেতার পকেট কাটা হয়েছে। তাদের সঙ্গে ভারতীয় কিছু পেঁয়াজ রপ্তানিকারকের সংশ্লিষ্টতা রয়েছে বলে ব্যবসায়ীদের নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে।

ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চট্টগ্রামের চাক্তাই ও খাতুনগঞ্জে প্রতিদিন অন্তত ৪০ ট্রাক পেঁয়াজ আসে। একেকটি ট্রাকে ১৫ টনের বেশি পেঁয়াজ আনা হয়। সে হিসাবে প্রতিদিন ৬০০ টন পেঁয়াজ বিক্রি হয় এই দুই পাইকারি বাজারে, যা চট্টগ্রাম ও আশপাশের জেলার চাহিদা মেটায়।

 

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, গত ১৭ অক্টোবরের আগে চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে দেশি পেঁয়াজ আকারভেদে বিক্রি হয় প্রতি কেজি ৬২ থেকে ৬৫ টাকায়। ১৭ অক্টোবর তা বেড়ে ৭০ থেকে ৭৫ টাকা হয়। অর্থাৎ গড়ে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে কেজিতে ৯ টাকা। ৩০ অক্টোবর পর্যন্ত তারা এই দামে পেঁয়াজ বিক্রি করেন। এই ১৪ দিনে তারা ক্রেতার পকেট থেকে হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় সাড়ে ৭ কোটি টাকা। গত ৩১ অক্টোবর পণ্যটির দাম আরও বাড়িয়ে বিক্রি হয় ৮০-৮৫ টাকায়। ৫ নভেম্বর পর্যন্ত তারা এই দামে পেঁয়াজ বিক্রি করেন। অর্থাৎ অক্টোবরের মাঝামাঝি সময়ে যে দামে পেঁয়াজ বিক্রি হতো তারচেয়ে কেজিতে গড়ে ১৯ টাকা বেশি আদায় করেছেন তারা। এই ছয় দিনে তারা হাতিয়ে নিয়েছেন প্রায় ৬ কোটি ৮৫ লাখ টাকা। ৬ নভেম্বর থেকে পেঁয়াজের দাম ১০৫ থেকে ১১০ টাকা পর্যন্ত উঠে যায়, যা এখনো অব্যাহত আছে। এই দুই সপ্তাহে সিন্ডিকেট পেঁয়াজ থেকে তুলে নিয়েছে প্রায় সাড়ে ২৬ কোটি টাকা। তিন ধাপে পেঁয়াজ ব্যবসায়ীদের পকেটে গেছে প্রায় ৪০ কোটি টাকা।

চট্টগ্রামের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, চাক্তাই-খাতুনগঞ্জে যারা পেঁয়াজ বিক্রি করেন তাদের সবাই কমিশন এজেন্ট। মূল বিক্রেতা ট্রাকে করে খাতুনগঞ্জ ও চাক্তাইয়ের কমিশন এজেন্টের কাছে পেঁয়াজ পাঠান, তিনি তা পাইকারি দরে বিক্রি করে কমিশন নেন। পেঁয়াজের দাম তারা নির্ধারণ করতে পারেন না। সীমান্তর্বর্তী এলাকায় কিছু আমদানিকারক আছেন। তারাও সিন্ডিকেটে জড়িত।

 

Manual5 Ad Code

ফরিদপুর-পাবনা এলাকায়ও বর্তমানে বেশ কিছু পেঁয়াজ মজুত রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানিয়েছে। প্রতিদিন সকালে তারা পেঁয়াজের দাম নির্ধারণ করে দেন। তারা যে দাম নির্ধারণ করে দেন, সে দামেই বিক্রি করেন এজেন্টরা।

চট্টগ্রাম শহরের শুলকবহর এলাকার মুদি দোকান কাশফুলের স্বত্বাধিকারী জালাল উদ্দিন বলেন, ‘আমরা যখন পাইকারি বাজার থেকে পেঁয়াজ আনতে যাই, তখন তাদের ইচ্ছামতো দর দিয়ে কিনতে হয়। তারা একেক দিন একেক দামে পেঁয়াজ বিক্রি করছে।’ তিনি মাঝারি মানের পেঁয়াজ বিক্রি করেছেন কেজি ১১০ টাকায়।

 

এ সময় হুমায়ুন রোডের ব্যবসায়ী নাদিম আহমেদ ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, ‘হঠাৎ করে দাম বেড়ে গেছে। ১২০ টাকা কেজি। এক টাকাও কমল না। তাই কেনা কমিয়ে দিয়েছি। আধা কেজি কিনলাম। আগে এক কেজি কিনতাম। সিন্ডিকেট করেই গোড়া থেকে দাম বাড়াচ্ছে। সরকারকে এটা ধরা দরকার। তা না হলে শুধু আমাদের পকেট থেকে টাকা যাবে।’

 

অন্য বাজারের ব্যবসায়ীদেরও একই অভিযোগ, সুযোগ বুঝে মোকামের ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দেন।

খুচরা বিক্রেতাদের মতো রাজধানীর পাইকারি বিক্রেতাদেরও অভিযোগ, মোকাম থেকেই সিন্ডিকেট করে বাড়ানো হচ্ছে দাম। কারওয়ান বাজারের মিনহাজ বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী মো. খলিল, কৃষি মার্কেটের কালু বেপারি বাণিজ্যালয়ের স্বত্বাধিকারী মো. কালু মিয়া এবং শ্যামবাজারের পেঁয়াজ ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক ও শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত বণিক সমিতির সহসভাপতি মো. মাজেদ বলেন, ‘মোকাম থেকেই পেঁয়াজের দাম বেঁধে দেন বেপারিরা। সেই দামে বিক্রি করতে হয়। কাজেই সিন্ডিকেট চক্রকে ধরলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code