প্রজন্ম ডেস্ক:
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতে গত তিন দশকে একের পর এক ‘মহাপরিকল্পনা’ নেওয়া হলেও, জ্বালানি নিরাপত্তা অর্জিত হয়নি। বিদেশি পরামর্শক ও ঋণদাতা সংস্থার এসব পরিকল্পনা দেশের বাস্তবতার সঙ্গে খাপ খায়নি। ফলে বেড়েছে আমদানিনির্ভরতা, আর্থিক চাপ ও পরিবেশঝুঁকি। অন্যদিকে, স্বার্থান্বেষী কিছু মানুষের সুবিধা বেড়েছে এবং বিদেশি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের স্বার্থরক্ষিত হয়েছে।
এ পরিপ্রেক্ষিতে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের অধীনে নতুন জ্বালানি মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু করেছে বাংলাদেশ এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার রিসার্চ কাউন্সিল (বিইপিআরসি)। স্বল্প ব্যয়ে নিজস্ব জনবল ও বিশেষজ্ঞদের সহায়তায় তৈরি এ পরিকল্পনার লক্ষ্য হলো বিদেশি স্বার্থের প্রভাবমুক্ত থাকা, বাস্তবসম্মত ও পরিবেশবান্ধব এবং দেশীয় সম্পদনির্ভর জ্বালানি-ভবিষ্যৎ নির্মাণ।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদেশি পরামর্শকের প্রভাবে তাদের স্বার্থরক্ষার এসব পরিকল্পনায় বিদ্যুৎ চাহিদাকে অস্বাভাবিকভাবে ফোলানো-ফাঁপানোর কারণে সক্ষমতার সংকটে ভুগছে দেশ। জ্বালানির অভাবে অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র দীর্ঘদিন অলস বসে থাকায় ক্যাপাসিটি চার্জ হিসেবে কোটি কোটি টাকা জনগণের পকেট গলে বেরিয়ে যাচ্ছে। গ্যাস আমদানির ঝোঁকে কমেছে দেশীয় অনুসন্ধান। বিশ্ব যখন নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকে ঝুঁকছে, তখনো দেশে পরিবেশবান্ধব এ জ্বালানির অগ্রগতি খুবই কম। ফলে লাখো কোটি টাকার প্রকল্প বাস্তবায়নের পরও জ্বালানি নিরাপত্তার স্বপ্ন আটকে আছে মাস্টারপ্ল্যানে।
সরকার নতুন যে মহাপরিকল্পনার উদ্যোগ নিয়েছে, তা কার্যকর করা গেলে জ্বালানি খাতের টেকসই উন্নয়নের পাশাপাশি আমদানিনির্ভরতা কমবে, সাশ্রয় করাও সম্ভব হবে, পরিবেশের ক্ষতিও কম হবে।
বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, ‘জ্বালানি খাতের মহাপরিকল্পনা আমরা নিজেরাই করছি। এতে ব্যয় কম হবে। এটা ট্রান্সফার মোডে করা হচ্ছে। আমরা মহাপরিকল্পনা তৈরি করে দেব; বাস্তবায়ন করবে পরবর্তী সরকার। পরিকল্পনায় এমন কিছু বিষয় থাকবে, যাতে ভবিষ্যতে কেউ নিজেদের ইচ্ছেমতো প্রকল্প নিতে না পারে। প্রকল্পগুলো হবে দেশের স্বার্থে এবং বাস্তবধর্মী।’
বিদেশি স্বার্থরক্ষার রোডম্যাপ : দেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতের মহাপরিকল্পনাগুলো করা হয়েছে বিশ্ব ব্যাংক, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি), জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সহায়তায়। পরামর্শক রাখা হয় ঋণদাতা সংস্থাগুলোর সুপারিশে। সবচেয়ে বেশি প্রভাব বিস্তার করেছে জাইকা।
বহুজাতিক ঋণদাতা সংস্থা ও পরামর্শক প্রতিষ্ঠানগুলোর সরাসরি বিনিয়োগ রয়েছে বাংলাদেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে। তারা বিপুল অর্থ ব্যয় করে। দেশের স্বার্থরক্ষার চেয়ে বিদেশি বিনিয়োগের স্বার্থই রক্ষা করা হয় বেশি। গত শতকের নয়ের দশকে প্রথম মহাপরিকল্পনার পেছনে এডিবি ব্যয় করেছে ৬০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার (বর্তমান বাজারমূল্যে প্রায় সাড়ে ৭ হাজার কোটি টাকা)। পরের মহাপরিকল্পনাগুলোতে কত ব্যয় হয়েছে তার সঠিক পরিসংখ্যান পাওয়া যায়নি। তবে ২০১০ সালে জাইকা যে মহাপরিকল্পনা করেছিল, তাতে পরামর্শক ফি হিসেবে ব্যয় করা হয়েছে অন্তত ৫০ কোটি টাকা।
পরামর্শক ব্যয়ের অর্থ আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর বিভিন্ন দাতা তহবিল থেকে ভর্তুকি হিসেবে দেওয়া হয়েছে। অর্থ ব্যয়ে সংস্থাগুলোর বাণিজ্যিক স্বার্থ প্রাধান্য পেয়েছে। এ অর্থে ব্যয় বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাতের অবকাঠামোর উন্নয়নের সুযোগ ছিল বাংলাদেশের। কিন্তু তা হয়নি।
এনজিও ফোরাম অন এডিবির এক গবেষণায় বলা হয়েছে, ১৯৭৩ সাল থেকে এডিবি বাংলাদেশের বিদ্যুৎ-জ্বালানি খাতে মোট ১৭.৩৪ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করেছে। অথচ প্রকল্প প্রণয়নের বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাংলাদেশের স্বার্থের কথা ভাবা হয়নি। এডিবির অর্থায়নে খুলনায় ২২৫ মেগাওয়াট ও ৮০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার দুটি গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করা হয়েছে। গ্যাসের অভাবে প্রকল্পগুলো বছরের পর বছর বন্ধ থাকায় এখন এগুলো বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বিগত দিনের মহাপরিকল্পনাগুলোতে প্রযুক্তি, কার্বন নিরপেক্ষতা ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির লক্ষ্য থাকলেও দেশীয় বাস্তবতা ও সক্ষমতা উপেক্ষিত হয়েছে। দেশীয় জ্বালানি উৎস ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতকে উপেক্ষা করে আমদানিনির্ভরতা বাড়ানো হয়েছে। হাইড্রোজেন, অ্যামোনিয়া কো-ফায়ারিং, কার্বন ক্যাপচার প্রভৃতিবিষয়ক প্রযুক্তি খাতকে অগ্রাধিকার দিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি খাতকে কোণঠাসা করা হয়েছে। এসব মহাপরিকল্পনার কারণে সরকারের ভর্তুকি ও দেনার পরিমাণ বাড়ছে। দফায় দফায় বাড়ছে ভোক্তা পর্যায়ে বিদ্যুৎ-জ্বালানির দাম।
পরিকল্পনা শুরু নব্বইয়ের দশকে : ১৯৯৫ সালে দেশের প্রথম পাওয়ার সিস্টেম মাস্টারপ্ল্যান (পিএসএমপি) তৈরি হয়। তখনই শুরু হয় দীর্ঘমেয়াদি বিদ্যুৎ পরিকল্পনার ধারণা। পিএসএমপি-১৯৯৫ ছিল এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় করা একটি কারিগরি পরিকল্পনা। এতে ভবিষ্যতের বিদ্যুৎ চাহিদা ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত বিনিয়োগের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছিল। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন ও বিতরণে সমন্বয়, জাতীয় গ্রিড সম্প্রসারণ, গ্রামাঞ্চলে মানসম্পন্ন বিদ্যুৎ পৌঁছে দেওয়া, বিদ্যুৎ সাশ্রয় ও দক্ষতা বৃদ্ধির বিষয়গুলো অন্তর্ভুক্ত ছিল। তবে এ পরিকল্পনার সঙ্গে বাস্তবতার ফারাক এতটাই ছিল যে, কোথাও বিদ্যুৎ উদ্বৃত্ত হয়েছে, কোথাও ঘন ঘন লোডশেডিং চলেছে। বিপরীতে বিদেশি স্বার্থরক্ষার প্রকল্পগুলো দ্রুত বাস্তবায়িত হয়েছে, যা জাতীয় স্বার্থকে হেয় করেছে। এ পরিকল্পনাই সরকারকে বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র বা আইপিপির ওপর নির্ভরশীল করেছে।
এরপর এ পরিকল্পনা ধারাবাহিকভাবে তিনটি পর্যায়ে বিবর্তিত হয় পিএসএমপি ২০১০, পিএসএমপি ২০১৬ ও আইইপিএমপি (ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টারপ্ল্যান) ২০২৩। এ মহাপরিকল্পনাগুলো সবচেয়ে প্রভাবশালী হিসেবে বিবেচিত।
পিএসএমপি ২০১০ : কয়লানির্ভরতার পথে বাংলাদেশ : জাপান আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সংস্থার (জাইকা) সহায়তায় ২০১০ সালে দ্বিতীয় মহাপরিকল্পনা করা হয়। এতে কয়লানির্ভর বিদ্যুৎ উৎপাদনের ওপর জোর দেওয়া হয়। পরিবেশগত ঝুঁকি ও জলবায়ুর প্রভাবকে প্রায় সম্পূর্ণভাবে উপেক্ষা করা হয়। পরিবেশবাদীদের আপত্তি সত্ত্বেও যাত্রা শুরু হয় রামপাল, পায়রা, মাতারবাড়ী প্রভৃতি বড় কয়লাবিদ্যুৎ প্রকল্পের। পরে আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থাগুলো দূষণযুক্ত প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করে দিলে এসব প্রকল্পের বেশিরভাগই স্থবির হয়ে পড়ে।
ওই পরিকল্পনায় গ্যাসের ঘাটতি মোকাবিলায় ব্যবস্থা গ্রহণ, এলএনজি আমদানি, বেসরকারি বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপন ও সঞ্চালন ব্যবস্থা উন্নয়নের কথা বলা হয়। কিন্তু দেশীয় গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম জোরদারের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সঞ্চালন ব্যবস্থার আধুনিকায়নও হয়েছে সীমিত পরিসরে। এলএনজি আমদানি ও বেসরকারি খাতের বিদ্যুৎকেন্দ্র স্থাপনে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়। কয়লার আমদানি ব্যয় বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন ব্যাহত হয় কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর। অনুসন্ধানে অবহেলার কারণে কমমূল্যের দেশীয় গ্যাসের উৎপাদন কমছে আর বাড়ছে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি। সেই সঙ্গে গ্যাস সংকট তীব্রতর হচ্ছে।
পরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য শক্তিকে গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। বাংলাদেশ নবায়নযোগ্য শক্তির বিকাশের সুযোগকে পুরোপুরি কাজে লাগাতে পারেনি।
পিএসএমপি ২০১৬ : জাপানি ছোঁয়া, জ্বালানি আমদানির ফাঁদ : পিএসএমপি ২০১০-এর পাঁচ বছর পর জাইকার সহায়তায় তৈরি হয় পিএসএমপি ২০১৬। এতে এলএনজি, আমদানিকৃত কয়লা ও পারমাণবিক শক্তিকে প্রধান জ্বালানি উৎস হিসেবে ধরা হয়। নবায়নযোগ্য শক্তিকে রাখা হয় একেবারে প্রান্তে। পরিকল্পনায় কয়লা ৩৫ শতাংশ, গ্যাস ৩৫ শতাংশ এবং নবায়নযোগ্য শক্তির অংশ মাত্র ১০ শতাংশ ধরা হয়। পাশাপাশি ভারত, ভুটান ও নেপালের সঙ্গে বিদ্যুৎ বাণিজ্যের সম্ভাবনার কথা উল্লেখ করা হয়। বাংলাদেশ ভারত ও নেপাল থেকে বিদ্যুৎ আমদানি শুরু করে, অথচ ‘রপ্তানির সুযোগ’ এখনো অধরা। ভারত থেকে উচ্চমূল্যের বিদ্যুৎ আমদানির চুক্তি, বিশেষত আদানি পাওয়ার প্রকল্পের বিষয়ে দেশ জুড়ে সমালোচনা চলছে। পরিকল্পনায় স্মার্ট গ্রিড, আধুনিক সঞ্চালন লাইন ও নবায়নযোগ্য শক্তি সম্প্রসারণের কথা থাকলেও বাস্তবে অগ্রগতি সীমিত। এ পরিকল্পনায় কয়লাকে অগ্রাধিকার দেওয়ায় বহু প্রকল্প অর্থনৈতিকভাবে অকার্যকর হয়ে পড়ে। জ্বালানি-আমদানির ওপর নির্ভরতা বাড়ে, বৈদেশিক মুদ্রার চাপ বাড়ে এবং জ্বালানি-নিরাপত্তা ঝুঁকিতে পড়ে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এ পরিকল্পনায় স্থানীয় বাস্তবতা ও প্রযুক্তিগত সক্ষমতার চেয়ে জাপানি বিনিয়োগস্বার্থই বেশি গুরুত্ব পেয়েছে। এটি দেশের নয়, বরং বিদেশি বিনিয়োগের রোডম্যাপ হিসেবে কাজ করেছে।
আইইপিএমপি ২০২৩ : কার্বন নিরপেক্ষতার স্বপ্ন, বাস্তবায়নের অনিশ্চয়তা : জাইকার সহায়তায় সর্বশেষ মহাপরিকল্পনা ‘ইন্টিগ্রেটেড এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার মাস্টারপ্ল্যান’ (আইইপিএমপি-২০২৩) করা হয়, যেখানে বিদ্যুৎ ও জ্বালানি দুই খাতকে একত্রে বিবেচনা করা হয়েছে। এতে ২০৫০ সালের মধ্যে কার্বন নিরপেক্ষতা অর্জনের লক্ষ্য নির্ধারণ করা হয়। ২০৪১ সালের মধ্যে ৩৫ শতাংশ বিদ্যুৎ আমদানিকৃত এলএনজি দিয়ে, ২০ শতাংশ কয়লা দিয়ে, ২০-২৫ শতাংশ নবায়নযোগ্য শক্তি দিয়ে এবং বাকিটা দেশীয় গ্যাস ও পারমাণবিক শক্তি থেকে উৎপাদন করার কথা বলা হয়। পরিকল্পনায় আধুনিক জ্বালানি মডেল ও চাহিদা পূর্বাভাস পদ্ধতি ব্যবহৃত হলেও, বাস্তবায়নের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত প্রস্তুতি স্পষ্ট নয়। আইইপিএমপিতে ২০৫০ সালেও নবায়নযোগ্য জ্বালানির পরিমাণ ২০ শতাংশের নিচে আটকে রাখার পরিকল্পনা করা হয়।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য শক্তির পরিমাণ আন্তর্জাতিকমানের তুলনায় অনেক কম। জাপানি প্রযুক্তি ও এলএনজি আমদানির ওপর অতিনির্ভরতা বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তাকে দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে।
এডিবির মতো জাপানও তার পরিকল্পনায় নিজের ব্যবসায়িক স্বার্থকেই প্রাধান্য দিয়েছে। দেশের বড় কয়লা বিদ্যুৎকেন্দ্র ও এলএনজিভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে জাপানের বড় বিনিয়োগ রয়েছে। আইইপিএমপিতে ২০৫০ সালের মধ্যে এলএনজি আমদানি ও এলএনজি-সংক্রান্ত অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা জুড়ে দেওয়া হয়।
সমালোচনার ইতিবাচক দিক হলো, প্রথমবারের মতো দেশের জ্বালানি পরিকল্পনায় কার্বন নিরপেক্ষতা ও এনার্জি রূপান্তরের সমন্বিত ধারণা এসেছে।
গ্যাস খাতের পরিকল্পনা : অনুসন্ধান নয়, আমদানির দৌরাত্ম্য : বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় ২০০৬ সালে তৈরি গ্যাস সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান (জিএসএমপি) অনুযায়ী, নতুন গ্যাস অনুসন্ধান ও পাইপলাইন সম্প্রসারণের কথা ছিল। কিন্তু অনুসন্ধান কার্যক্রম অবহেলিত থেকে যায়।
সংকটের মধ্যেও উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস পাইপলাইন প্রকল্প নেওয়া হয়, যেখানে কোটি কোটি টাকার অবকাঠামো তৈরি হলেও গ্যাস সরবরাহ করা যাচ্ছে না। ফলে সরকারের বিপুল অর্থের অপচয় হয়েছে।
জিএসএমপিতে গ্যাস বিতরণের দক্ষতা বাড়িয়ে সিস্টেম লস কমানোর কথা বলা হলেও তা করা হয়নি। বাস্তবায়িত হয়েছে ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানি প্রকল্প।
জ্বালানি দক্ষতা পরিকল্পনা : এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের (এডিবি) সহায়তায় ২০১৫ সালে তৈরি করা হয় এনার্জি ইফিসিয়েন্সি অ্যান্ড কনজারভেশন মাস্টারপ্ল্যান (ইইসিএমপি)। এতে ২০৩০ সালের মধ্যে শিল্প, গৃহস্থালি ও পরিবহন খাতে জ্বালানি দক্ষতা বাড়ানোর কথা বলা হয়। তবে এর জন্য সংশ্লিষ্ট কাজের গতি খুবই ধীর, তদারকির ব্যবস্থাও দুর্বল।
আপডেটেড জিএসএমপি ২০১৭ : বিশ্বব্যাংকের সহায়তায় গ্যাস সেক্টর মাস্টারপ্ল্যান ২০১৭ হালনাগাদ করা হয়। এতে এলএনজি আমদানি, শিল্পে জ্বালানি স্থানান্তর, গ্যাস পাইপলাইন আধুনিকায়ন ও পরিবেশগত ঝুঁকি বিবেচনার কথা বলা হয়। ২০১৮ সাল থেকে শুরু হয় এলএনজি আমদানি। কিন্তু পরিকল্পনা অনুযায়ী দরকারি সংশ্লিষ্ট কাজগুলোই করা হয়নি। ফলে দেশীয় অনুসন্ধান কমেছে, আমদানিনির্ভরতা বেড়েছে।
দেশি জনবল ও বিশেষজ্ঞদের নেতৃত্বে আইইপিএমপি : বিদ্যুৎ, জ্বালানি খাতের এমন দুরবস্থা থেকে উত্তরণে জুন মাস থেকে একটি সমন্বিত জ্বালানি মহাপরিকল্পনার কাজ শুরু হয়েছে। পুরো কাজের সমন্বয় করছে বিইপিআরসি (বাংলাদেশ এনার্জি অ্যান্ড পাওয়ার রিসার্চ কাউন্সিল)।
প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যান মোহাম্মদ ওয়াহিদ হোসেনের নেতৃত্বে একটি স্টিয়ারিং কমিটি গঠন করা হয়েছে। এর অধীনে রয়েছে সমন্বয় কমিটি ও বিভিন্ন ওয়ার্কিং গ্রুপ। এ কাজে যুক্ত আছেন মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন সংস্থার অন্তত ২০০ জনবল। পরিকল্পনায় ব্যয়ের পরিমাণ খুবই কম।
কাজের অগ্রগতি সম্পর্কে বিইপিআরসির সদস্য ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা জ্বালানি খাত নিয়ে কাজ করছি। আর বিদ্যুৎ নিয়ে কাজ করছে বিদ্যুৎ বিভাগ। এরপর দুই খাতের সমন্বয়ে একটি মহাপরিকল্পনা করা হবে। এটা নতুন মহাপরিকল্পনাও হতে পারে আবার সংশোধিত আইইপিএমপিও হতে পারে। ডিসেম্বরের মধ্যে খসড়া মহাপরিকল্পনা তৈরির কাজ শেষ হবে বলে আশা করছি।’
তিনি বলেন, ‘অতীতের মহাপরিকল্পনাগুলো ছিল বিদেশনির্ভর। স্থানীয় তথ্য-উপাত্ত এবং জ্বালানি চাহিদার বিষয়টি গুরুত্ব দেওয়া হয়নি। জনগণ এবং বিশেষজ্ঞদেরও মতামত নেওয়া হয়নি। এবার আমরা বিভিন্ন খাতের মানুষের সঙ্গে কথা বলছি। গত ২৫ বছরের বিভিন্ন ডেটা সংগ্রহ করে সেগুলোর বিশ্লেষণ করছি। জাতীয় ডেটা সেন্টার করারও উদ্যোগ রয়েছে।’
‘এবারের মহাপরিকল্পনায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির ব্যবহার, দেশীয় গ্যাস এবং অন্যান্য জ্বালানির উৎপাদন বাড়ানোর বিষয়গুলো থাকবে। সাশ্রয়ী মূল্যে জ্বালানির ব্যবহার ও দক্ষতা বৃদ্ধি, জ্বালানি সাশ্রয়, কর্ম কার্বন নিঃসরণ, আমদানিনির্ভরতা কমানোর বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। ২০৫০ সালকে লক্ষ্য করে করা হচ্ছে এ পরিকল্পনা’ যোগ করেন রফিকুল ইসলাম। তিনি বলেন, ‘স্থানীয় জীবাশ্ম জ্বালানি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও আমদানিনির্ভর জ্বালানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের সক্ষমতা, সম্ভাবনা, ভবিষ্যৎ করণীয়, সুবিধা-অসুবিধার বিষয়গুলো তুলে ধরা হবে। এরপর সরকার সিদ্ধান্ত নেবে এ বিষয়ে।’
Sharing is caring!