প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৯শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৫ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৩শে জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

‘পুশ ইন’ ঠেকাতে কী করবে বাংলাদেশ?

editor
প্রকাশিত জুন ৫, ২০২৫, ০৭:৫২ অপরাহ্ণ
‘পুশ ইন’ ঠেকাতে কী করবে বাংলাদেশ?

প্রজন্ম ডেস্ক:

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর ভারতের সঙ্গে সম্পর্কের টানাপড়েনের মধ্যে সীমান্ত দিয়ে মানুষকে ঠেলে দেওয়া বা ‘পুশ ইন’ বাংলাদেশের জন্য নতুন সমস্যা হয়ে এসেছে, যা সমাধানে ‘পাল্টা ব্যবস্থা’ নেওয়ার উপায়ও মিলছে না।

এ অবস্থায় আন্তর্জাতিক সম্পর্কের বিশ্লেষকরা বলছেন, এ সংকটের সমাধান করতে হবে, দুই দেশের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে। এছাড়া, ভিন্ন কোনো পথ নেই।

তারা বলছেন, বাংলাদেশ যদি ভারতের পাঠানো নাগরিকদের ঠেলে ফেরত পাঠায় বা ‘পুশব্যাকও’ করে, তাতে ঝামেলা মিটবে না। বরং বাড়বে এবং মানবিক সংকট তৈরি হবে।

 

সাবেক রাষ্ট্রদূত এম হুমায়ুন কবির বলেন, “পুশব্যাক করে আমরা পাঠাতে পারি। তাতে লাভ কী হবে? এই মানুষগুলোর কষ্ট বাড়বে। এটা তো সমাধান হলো না। এটা একটা প্রতিক্রিয়া জানানো হবে মাত্র। কাজেই এখানে কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনা ছাড়া, আলাপ-আলোচনা ছাড়া আর কোনো ব্যবস্থা সম্ভব বলে মনে হচ্ছে না।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলছেন, “ভারত থেকে ‘পুশ ইন’ হচ্ছে। সেটি বাস্তবিক অর্থে ঠেকানো সম্ভব নয়। এটা নিয়ে ভারতের সঙ্গে চিঠি আদান–প্রদান হচ্ছে। আমরা বলছি এটি যাতে পদ্ধতি অনুযায়ী হয়।”

আর, বাংলাদেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিজিবি সীমান্ত এলাকায় ভারতের সীমান্তরক্ষী বাহিনী-বিএসএফ নিয়মিত পতাকা বৈঠক করার কথা বলছে।

 

কোন পরিপ্রেক্ষিতে শুরু হলো ‘পুশ ইন’

গত ২৭ এপ্রিল ভারতের গুজরাটের আহমেদাবাদ ও সুরাট শহরে নারী ও শিশুসহ এক হাজার ২৪ জন বাংলাদেশিকে আটকের তথ্য দেয় সেখানকার রাজ্য পুলিশ। ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ‘হিন্দুস্তান টাইমস’ এ নিয়ে খবর প্রকাশিত হয়।

পরদিন আহমেদাবাদে সংবাদ সম্মেলনে এসে রাজ্য পুলিশের প্রধান বিকাশ সহায় বলেন, “মুখ্যমন্ত্রী ভূপেন্দ্র প্যাটেলের নির্দেশনায় এক রাতের অভিযানে আহমেদাবাদ থেকে ৮৯০ বাংলাদেশিকে আটক করা হয়। ১৩৪ জনকে ধরা হয় সুরাট থেকে। অনুপ্রবেশ কিংবা অনুপ্রবেশকারীদের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড মোকাবিলায় এ অভিযান জরুরি ছিল।”

এরপর থেকেই মূলত বাংলাদেশের সীমান্ত এলাকা দিয়ে মানুষকে ঠেলে পাঠানো শুরু করে দেশটির সীমান্তরক্ষী বাহিনী।

এভাবে সীমান্ত দিয়ে মানুষকে ঠেলে পাঠানোর বিষয়ে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেছেন, “কিছুদিন আগে শুনছেন যে গুজরাটে একটা কলোনির মতো ছিল, বাঙালি কলোনির মতো, বাঙালি বস্তি। ওইটা ওরা ভেঙে দিছে। ভেঙে দেওয়ার পরেই এটা শুরু হইছে।”

তার আগে গত ২২ এপ্রিল জম্মু-কাশ্মীরের পেহেলগামে বন্দুকধারীদের হামলায় ২৬ জন বেসামরিক নাগরিক নিহত হন। এর পরিপ্রেক্ষিতে দেশটির বিভিন্ন রাজ্যে বসবাসকারী কথিত ‘অনুপ্রবেশকারীদের’ ধরতে ধরপাকড় ও অভিযান শুরু করে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।

‘অবৈধ অভিবাসী’ সন্দেহে বিভিন্ন রাজ্যে গ্রেপ্তার বাংলা ভাষাভাষিদের বিমানে করে বাংলাদেশ সীমান্ত এলাকায় নিয়ে আসা হচ্ছে। এরপর তাদেরকে তুলে দেওয়া হচ্ছে বিএসএফের হাতে। আর বিএসএফ সময় ও সুযোগ বুঝে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়ে দিচ্ছে তাদের।

 

মে মাসেই ১২২২ জনকে ঠেলে দিয়েছে ভারত

৭ মে প্রথম দফায় খাগড়াছড়ি জেলার মাটিরাঙ্গা ও পানছড়ি সীমান্ত দিয়ে ৬৬ জন ও কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে আরও ৩৬ জনকে দিয়ে শুরু হওয়া ‘পুশ ইন’ অব্যাহত রয়েছে।

বিজিবির সদর দপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, গত ৭ মে থেকে ৩১ মে পর্যন্ত মোট ১ হাজার ২২২ জনকে ভারত বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে; যা এখনও অব্যাহত আছে।

এর মধ্যে খাগড়াছড়ি সীমান্ত দিয়ে ১৩২ জন, সিলেট সীমান্ত দিয়ে ১১৫ জন, মৌলভীবাজার সীমান্ত দিয়ে ৩৮০ জন, হবিগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ৪১ জন, সুনামগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ১৬ জন, কুমিল্লা সীমান্ত দিয়ে ১৩ জন, ফেনী সীমান্ত দিয়ে ৫২ জন, কুড়িগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ৯৩ জন, লালমনিরহাট সীমান্ত দিয়ে ৮৫ জন, ঠাকুরগাঁও সীমান্ত দিয়ে ১৯ জন, পঞ্চগড় সীমান্ত দিয়ে ৩২ জন, দিনাজপুর সীমান্ত দিয়ে ১৫ জন, চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্ত দিয়ে ১৭ জন, কুষ্টিয়া সীমান্ত দিয়ে ৯ জন, মেহেরপুর সীমান্ত দিয়ে ৩০ জন, চুয়াডাঙ্গা সীমান্ত দিয়ে ১৯ জন, ঝিনাইদহ সীমান্ত দিয়ে ৫২ জন এবং সাতক্ষীরা সীমান্ত দিয়ে ২৩ জন এবং সুন্দরবনের গহীন অরণ্যের মান্দারবাড়িয়া এলাকায় ৭৮ জনকে পুশ ইন করা হয়েছে।

‘পুশ ইন’ রোধে বিজিবির তৎপরতা প্রসঙ্গে বাহিনীর কারও আনুষ্ঠানিক বক্তব্য পাওয়া না গেলেও সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা বলছেন, “যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ না করে পুশইন করায় বিএসএফের সাথে বিভিন্ন পর্যায়ে পতাকা বৈঠকের মাধ্যমে মৌখিক ও লিখিতভাবে জোরালো প্রতিবাদ জানিয়েছে বিজিবি। পুশ ইন রোধে বিজিবি সীমান্তে গোয়েন্দা নজরদারি ও টহল তৎপরতা বৃদ্ধি করে সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থানে রয়েছে।”

 

আইনে কী আছে?

কোনো রাষ্ট্রের সীমান্তরক্ষী বাহিনী কর্তৃক ব্যক্তি অথবা ব্যক্তিদের জোরপূর্বক প্রতিবেশী রাষ্ট্রে ঠেলে দেওয়ার ক্ষেত্রে কোনো আইনি প্রক্রিয়া অনুসরণ করে করা হয় না। ব্যক্তিদের আশ্রয় প্রার্থনার সুযোগও দেওয়া হয় না।

এটি আন্তর্জাতিক অভিবাসন ও মানবাধিকার আইন অনুযায়ী বিতর্কিত এবং অনেক ক্ষেত্রে অবৈধ হিসেবে বিবেচিত হয়।

আন্তর্জাতিক আইনে ‘পুশ-ইন বা পুশব্যাকের’ কোনো নির্দিষ্ট সংজ্ঞা নেই। তবে এটি সাধারণত ‘নন-রিফাউলমেন্ট’ বা অ-প্রত্যর্পণ নীতির লঙ্ঘন হিসেবে বিবেচিত হয়।

১৯৫১ সালের শরণার্থী কনভেনশনের ৩৩(১) ধারা অনুযায়ী ‘নন-রিফাউলমেন্ট’ নীতি প্রযোজ্য। এ নীতি অনুযায়ী, কোনো ব্যক্তিকে এমন দেশে পাঠানো যাবে না যেখানে তার প্রাণ বা স্বাধীনতা হুমকির মুখে পড়বে। এই নীতি অন্যান্য আন্তর্জাতিক মানবাধিকার চুক্তিতে অন্তর্ভুক্ত।

‘পুশ ইন’ প্রক্রিয়ায় ব্যক্তিদের কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়াই ফেরত পাঠানো হয়, যা আন্তর্জাতিক আইনের এই মৌলিক নীতির পরিপন্থী।

বিশেষ করে, ইউরোপীয় মানবাধিকার কনভেনশনের প্রোটোকল ৪-এর ধারা ৪-অনুযায়ী শরণার্থীদের সমষ্টিগত বহিষ্কার নিষিদ্ধ।

আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠন অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বহুবার দক্ষিণ এশিয়ার সীমান্তে ‘পুশ ইন’ প্রক্রিয়াকে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন হিসেবে অভিহিত করেছে। বিশেষ করে আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন এবং ব্যক্তিকে রাষ্ট্রবিহীন করে তোলার ঝুঁকি তৈরির কারণে তারা এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা করে আসছে।

২০১৮ সালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছিল, “ভারতের পুশব্যাক নীতিতে আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘিত হয় এবং এতে মানুষ রাষ্ট্রবিহীন হওয়ার ঝুঁকিতে পড়ে।”

 

আইনি পথে কেন হাঁটছে না ভারত

সীমান্তে ‘অবৈধভাবে পুশ ইন’ নিয়ে কখনই ভারতের কোনো দপ্তরের কিংবা বিএসএফের আনুষ্ঠানিক কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।

বিজিবির তরফ থেকে নির্ধারিত সীমান্ত এলাকা সংলগ্ন বিএসএফের কাছে যোগাযোগ ও পতাকা বৈঠক করলেও তারা বিষয়টি কখনই স্বীকার করেনি।

কিন্তু, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে এভাবে ঠেলে না পাঠিয়ে আইন মেনে যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে পাঠানোর কথা বলা হচ্ছে।

সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, “আমরা তাদের জানিয়েছি-আমাদের বাংলাদেশি যদি কেউ ইন্ডিয়ায় থেকে থাকে, আপনারা প্রপার চ্যানেলে পাঠান। প্রত্যেকটার একটা প্রপার চ্যানেল আছে। যেমন ইন্ডিয়ান যারা বাংলাদেশে আছে, তাদেরও আমরা প্রপার চ্যানেলে পাঠাই।

“আমরা কিন্তু কাউরে পুশ ইন করি না। এজন্য তাদেরও বলা হইছে, তারা প্রপার চ্যানেলে যদি বাংলাদেশিরা থাকে তাদের পাঠাক।”

নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, “আইনিপথে ফেরত পাঠানোর বিষয়টি সময়সাপেক্ষ হওয়ায় পুশ ইন করছে ভারত।”

তার ভাষ্য, “আইন অনুযায়ী দেশটিতে বসবাসরত অবৈধ বাংলাদেশিদের শনাক্ত করার পর গ্রেপ্তার দেখাতে হবে। আইনি প্রক্রিয়ায় বিচার শেষে তাদের সাজা হবে, তারপর কূটনৈতিক প্রক্রিয়ায় তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে ফেরত পাঠাতে হবে।”

‘পুশ ইনের’ মধ্যেই ভারতে অবস্থানরত ২ হাজার ৪৬১ জনকে ‘বাংলাদেশি নাগরিক’ অভিহিত করে তাদের ফিরিয়ে নিতে আনুষ্ঠানিকভাবেও বাংলাদেশকে জানানোর কথা বলেছে দেশটি।

গত ২১ মে ভারতের পক্ষ থেকে এক চিঠিতে তাদের ফিরিয়ে নিতে বলা হয়েছে জানিয়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রনধীর জয়সওয়াল বলেছেন, “বাংলাদেশি নাগরিকদের একটি তালিকা ইতোমধ্যেই ঢাকায় পাঠানো হয়েছে।”

দেশটির সরকারি বিভিন্ন দপ্তরের কর্মকর্তাদের বরাতে সংবাদমাধ্যমে খবর এসেছে, আরও অন্তত দুই হাজার ব্যক্তিকে ভারত-বাংলাদেশের বিভিন্ন সীমান্তবর্তী এলাকায় রাখা হয়েছে।

ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসে প্রকাশিত প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, সীমান্তবর্তী রাজ্য ত্রিপুরা, মেঘালয় ও আসামসহ বিদেশিদের বিরুদ্ধে অভিযান বেশি চলছে গুজরাট, হরিয়ানা, দিল্লি, মহারাষ্ট্র ও রাজস্থানে।

 

ভারতে কেন গিয়েছিলেন?

ঠেলে পাঠানো বাংলাদেশিদের অধিকাংশই নিম্ন আয়ের মানুষ। তারা বিভিন্ন সময়ে কাজের খোঁজে অবৈধ পথে ভারতে পাড়ি জমিয়েছিলেন। তারা সেখানে বিভিন্ন রাজ্যে ছোটখাট কারখানা ও ইটভাটা শ্রমিক বা দিনমজুর হিসেবে কাজ করতেন।

গেল ২৪ মে কুড়িগ্রামের ভূরুঙ্গামারী সীমান্ত দিয়ে পাঠানো ১২ জনের বাড়িই ফুলবাড়ী উপজেলায়। এসব ব্যক্তিকে আটকের পর তারা পুলিশকে বলেছেন, কাজের খোঁজে প্রায় ১০ বছর আগে অবৈধ পথে ভারতে যান তারা। সম্প্রতি ভারতের পুলিশের হাতে আটকের পর তারা ২০ দিন জেলে বন্দি ছিলেন। এরপর ওই রাতে বিএসএফ সদস্যরা তাদের বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেন।

৩০ মে ফেনীর মটুয়া সীমান্ত দিয়ে ঠেলে পাঠানো ১৩ জনকে উদ্ধারের পর ছাগলনাইয়া থানায় হস্তান্তর করে বিজিবি।

বিজিবির ভাষ্য, “বিএসএফের পুশ ইন করা ১৩ বাংলাদেশিকে প্রথমে হাত ও চোখ বেঁধে সীমান্ত এলাকায় নিয়ে আসা হয়। পরে প্রতিকূল আবহাওয়ার সুযোগে প্রত্যেকের হাত ও চোখের বাঁধন খুলে সুকৌশলে বাংলাদেশে পুশ ইন করা হয়।”

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, রাতের অন্ধকার ও এলাকা সম্পর্কে অবগত না থাকায় এসব ব্যক্তি মটুয়া এলাকায় পরিত্যক্ত একটি বাড়িতে অবস্থান করছিল। আটক ১৩ জনের মধ্যে রয়েছে ৬ জন শিশু, ৩ জন নারী ও ৪ জন পুরুষ। তারা সবাই কুড়িগ্রাম জেলার বাসিন্দা।

প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে আটকরা বিজিবিকে জানিয়েছে, বিভিন্ন সময় ইটভাটায় কাজ করার জন্য তারা ভারতে প্রবেশ করেছিল।

বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, “তারা মূলত বাংলাদেশি, যারা গত কয়েকবছর থেকে, এমনকি ২০-৩০ বছর আগেও ভারতে বিভিন্নভাবে গমন করেছিল।

“এদের মধ্যে আবার যারা অনেক আগে ২০-৩০ বছর আগে গেছে, তাদের সন্তানাদিও রয়েছে। তারা ভারতেই জন্মগ্রহণ করেছে। তাই তাদের নাগরিকত্বসহ বিভিন্ন বিষয়ে জটিলতা সৃষ্টি হওয়ার একটা আশঙ্কা আছে মনে করেই এরা পুশ ইন করছে। অন্য কী কারণে আমরা জানতে পারছি না।”

 

৩০ মে বিএসএফের ঠেলে দেওয়া ছয়জনকে লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলায় আটকের পর বিজিবি বলেছে, ভারতের আসাম রাজ্যের সীমান্তবর্তী এলাকা থেকে গীতলদহ বিএসএফ ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের বাংলাদেশের পাটগ্রামের দইখাওয়া সীমান্ত পিলার ৯০৮/এস এর কাছে ঠেলে দেয়।

তারা প্রথমে স্থানীয় এক ব্যক্তির আশ্রয়ে ছিলেন। পরে বুড়িমারী রেলস্টেশন এলাকায় সন্দেহজনকভাবে ঘোরাফেরা করার সময় বিজিবি তাদের আটক করে।

আটকদের একজন কিসমত আলী তখন বলেন, তার বাড়ি আসামের নহাটি গ্রামে। তার ভারতীয় পরিচয়পত্র, আধার কার্ড, প্যান কার্ড সবই রয়েছে। তবু তাদের বাংলাদেশি ‘বানিয়ে’ জোর করে সীমান্ত দিয়ে বাংলাদেশে পাঠানো হয়েছে।

বুড়িমারী বিজিবি ক্যাম্পের কোম্পানি কমান্ডার সুবেদার আবুল কাসেম বলেন, “আটকদের প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদ শেষে তাদের কাগজপত্র বিএসএফের কাছে পাঠানো হয়েছে। বিএসএফ জানিয়েছে, বিষয়টি ভারতের পুলিশের মাধ্যমে যাচাই করে জানাবে। তারা যদি প্রকৃত ভারতীয় নাগরিক হন, তবে কূটনৈতিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে তাদের ফেরত দেওয়া হবে।”

বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী বলেন, “যারা আসছেন, তাদের অনেকের মৌখিক ভাষ্য, তাদের আইডি কার্ড, আধারকার্ড ছিল, যেটা রেখে দেওয়া হয়েছে।”

তবে এটি প্রমাণ করা বিজিবির পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না, বলেন তিনি।

স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেছেন, “এর ভেতর কিছু রোহিঙ্গাও চলে আসছে। এসব রোহিঙ্গা আবার আমাদের দেশেও ছিল, ওরাও গেছে। আবার যারা ইন্ডিয়ার রোহিঙ্গা, তাদেরও পাঠায়ে দিচ্ছে। এজন্য আমরা এটার প্রতিবাদলিপি পাঠিয়েছি।”

 

‘পুশ ইনে’ বাংলাদেশের নিরাপত্তা ঝুঁকি কতটা?

লালমনিরহাটের পাটগ্রাম সীমান্ত দিয়ে ২১ মে ঠেলে পাঠানো ১১ নারী-শিশুকে আটক করে বিজিবির হাতে তুলে দেন স্থানীয় লোকজন।

তারা বলেছেন, ‘পুশ ইনের’ শিকার এসব ব্যক্তি দেশে ঢোকার পর হেঁটে পাটগ্রামের দিকে যেতে শুরু করেন। তারা স্থানীয় নতুন বাজারে পৌঁছলে লোকজন সন্দেহ করে এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে। তখন ভারত থেকে তাদের পাঠানো হয়েছে বলে তারা স্বীকার করেন।

আটকদের বরাতে স্থানীয়রা বলছেন, শুধু ১১ জন নয়, সেদিন দুই দফায় অন্তত ৫০ জনকে বাংলাদেশে ‘পুশ ইন’ করা হয়েছে। বাকিরা আত্মগোপনে চলে গেছেন।

ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, দেশটির স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ রাজ্য সরকারগুলোকে নির্দেশ দিয়েছিলেন, অবৈধভাবে যারা বসবাস করছেন, সেই বিদেশিদের চিহ্নিত করে যেন দ্রুত ফেরত পাঠানো হয়।

এর ধারাবাহিকতায় দেশটি দুই হাজারের বেশি মানুষকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে, যা কাশ্মীর হামলার পর দেশটির ‘বিভিন্ন অভিযানেরই অংশ’।

এভাবে বিজিবি বা প্রশাসনের চোখ এড়িয়ে কেউ দেশের অভ্যন্তরে ঢুকে পড়লে ‘নিরাপত্তাঝুঁকি’র বিষয়টি উড়িয়ে দিচ্ছেন না সংশ্লিষ্টরা।

‘পুশ ইনের’ মধ্যে জঙ্গি বা অপরাধী দেশে প্রবেশের আশঙ্কা থাকে কিনা জানতে চাইলে সম্প্রতি বিজিবি মহাপরিচালক মেজর জেনারেল মোহাম্মদ আশরাফুজ্জামান সিদ্দিকী সংবাদমাধ্যমকে বলেন, “কোনোকিছুকেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। সবদিক থেকে সকল সম্ভাবনা রয়ে যায়।

“তবে আমাদের দেশের জন্য, জাতির জন্য ক্ষতিকর হবে, এমন কোনোকিছুই যাতে না হয় সেজন্য আমরা জোরদার নিরাপত্তা নিশ্চিতের চেষ্টা করছি।”

 

আলোচনাই সমাধানের উপায়

সীমান্ত দিয়ে ঠেলে পাঠানো নিয়ে সমস্যা সমাধানে দুই দেশকেই আলোচনায় বসতে হবে বলে মনে করছেন আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষকরা।

ভারতে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্টদূত মুন্সী ফয়েজ আহমদ বলেন, “পুশ ইন যেটা হচ্ছে, সেটা তো আইনিভাবে মোটেই যৌক্তিক নয়। দুই দেশের মধ্যে চুক্তি আছে, সবকিছু আছে, সুতরাং কাউকে যদি ফেরত পাঠাতে হয়, আনুষ্ঠানিক-অনানুষ্ঠানিক যেভাবেই হোক, দুই দেশের সম্মতির মাধ্যমে করতে হবে।

“আগে তারা আসলেই বাংলাদেশি কিনা সেটা বুঝতে হবে, তারপর বাংলাদেশ তাদের আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে নিবে। এটাই হল পদ্ধতি। তাদের নামধাম যাচাই করে যখন আমরা দেখব, যে না ঠিক আছে, তখন তাদের ভারতীয়রা পৌঁছে দিবে আমাদের কাছে। সেটাই পদ্ধতি। এর বাইরে যেটা হয়, সেটা বেআইনি।”

তিনি বলেন, “আমাদের সাথে তাদের সম্পর্কটা ভালো যাচ্ছে না। সেটার জন্য কিছুটা তারা দায়ী, কিছুটা আমরাও। আমরা তো দায় এড়াতে পারছি না। আমরা কি সেটা চেষ্টা করছি এমনভাবে যাতে ওরা এ অবস্থান থেকে সরে দাঁড়ায়। আমরা কি যথেষ্ট চেষ্টা করছি, নাকি আমরা যা চেষ্টা করছি তাতে কাজ হচ্ছে না। কাজ না হলে সেটা যথেষ্ট নয়।

“আমরা মনে করতে পারি, আমরা যথেষ্ট করছি, কিন্তু কাজ তো হচ্ছে না। সাধারণভাবে দুই দেশের সম্পর্ক ভালো হওয়া জরুরি। সেটা না হবে যতক্ষণ পর্যন্ত, যতক্ষণ টানাপোড়েন থাকবে, ততক্ষণ ভারত তো অনেক বড়, ইচ্ছা করলেই আমাদের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে পারে।”

তাহলে করণীয় কী? জবাবে মুন্সী ফয়েজ বলেন, “আমাদের সতর্ক হতে হবে, আমাদের বাস্তবতা মেনে নিতে হবে। আমাদের ভারতের সাথে হম্বিতম্বি করলে চলবে না। সমস্যা তো থাকেই, সমস্যাটা মিটমাট করে নিতে হবে। আমাদের নিজেদের বাস্তবতা বুঝে সেভাবে সমাধান করতে হবে।

“ভালোভাবে আলাপ করে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব সম্পর্কটা স্বাভাবিক করতে হবে। তার জন্য ছাড়ও দিতে হবে, আবার ওদের কাছ থেকে প্রয়োজনে আমাদের স্বার্থটাও আদায় করে নিতে হবে।”

আরেক সাবেক রাষ্ট্রদূত ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক এম হুমায়ুন কবিরও প্রায় একইরকম কথা বলেছেন।

তিনি বলেন, “১৯৯৫ সালের যে সীমান্ত নীতিমালা আছে, তার আওতায় এ ধরনের পুশ ইন সমর্থন করার সুযোগ নেই। এবং এটা করা ঠিকও না। কিন্তু, ভারত এটা করছে। ভারতীয়রা বলছে, যাদের পুশ ইন করা হচ্ছে, এরা বাংলাদেশি মানুষ, সেখানে ছিল। সেটারও পদ্ধতি আছে।

“যদি বাংলাদেশি মানুষ সেখানে থাকে, ভারত জানাবে বাংলাদেশকে, আমরা সেটা যাচাই করে প্রচলিত ব্যবস্থা যেটা আছে, আমরা তাদের জানাতে পারি। সেটাও গ্রহণ করার পদ্ধতি আছে। কিন্তু, ভারত এই মুহূর্তে কোনো পদ্ধতিই মানছে না।”

এই বিষয়ে বাংলাদেশের নির্দিষ্টভাবে কী করার আছে জানতে চাইলে সাবেক এই রাষ্ট্রদূত বলেন, “পুশব্যাক করে আমরা পাঠাতে পারি। তাতে লাভ কি হবে? এই মানুষগুলোর কষ্ট বাড়বে। এটা তো সমাধান হলো না। এটা একটা প্রতিক্রিয়া জানানো হতে পারে। কাজেই এখানে কূটনৈতিক ব্যবস্থাপনা এবং দ্বিপক্ষীয় আলাপ-আলোচনায় যেতে হবে।”

 

‘পুশ ইন ঠেকানো সম্ভব নয়’

ভারত থেকে বাস্তবিক অর্থে ‘পুশ ইন’ ঠেকানো সম্ভব নয় বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।

মঙ্গলবার বিকেলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক ব্রিফিংয়ে তিনি বলেন, “আজ বা আগামীকাল আবার চিঠি দেবে বাংলাদেশ। দুই দেশের বিদ্যমান কনস্যুলার সংলাপ ব্যবহার করে বিষয়গুলোকে নিয়মের মধ্যে নিয়ে আসা যায় কি না, সে চেষ্টা করা হচ্ছে।”

তিনি বলেন, “তারা কিছুক্ষেত্রে বলেছে– অনেক ঘটনা যাচাই পর্যায়ে আটকে রয়েছে, সেগুলো ঠিকমতো বাংলাদেশ করছে না। যাচাই করে দেখেছি খুব দীর্ঘদিনের তালিকা রয়েছে। পাশাপাশি এটাও দেখেছি যে ভারতের তালিকা অনুযায়ী যাচাই করে অনেককে ফেরত নেওয়া হয়েছে। কাজেই দুপক্ষের বক্তব্য থাকতে পারে।”

Sharing is caring!