প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৬ই জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা শ্রাবণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২১শে মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি

বাড়ছে রাজনৈতিক সংঘর্ষ

editor
প্রকাশিত জুন ১৪, ২০২৫, ১২:৩৩ অপরাহ্ণ
বাড়ছে রাজনৈতিক সংঘর্ষ

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

নির্বাচনের সময় যতই ঘনিয়ে আসছে ততই বাড়ছে রাজনৈতিক সংঘাত। এর মাত্রা আরও তীব্র হবে বলে আশঙ্কা করছেন অপরাধ বিশেষজ্ঞরা। চলতি বছরের ৫ মাস ১১ দিনে দেশে রাজনৈতিক সংঘাতে প্রাণ হারিয়েছেন ৫৬ জন। গড়ে প্রতি মাসে প্রাণ হারিয়েছেন ১০ জনেরও বেশি। গত মে মাসে প্রাণ হারান ৯ জন। চলতি বছরের প্রথম ৪ মাসে রাজনৈতিক সংঘাতে প্রাণ হারান ৪৬ জন।

সর্বশেষ গত মঙ্গলবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে স্থানীয় বাসিন্দাদের হাতে আটক নিষিদ্ধ সংগঠন ছাত্রলীগের এক নেতাকে ছাড়িয়ে নেওয়ার সময় বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে সংঘর্ষে এক যুবদল কর্মী নিহত হন। একই দিন নোয়াখালীর হাতিয়ায় বিএনপির দুই পক্ষের মধ্যে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এতে উভয় পক্ষের অন্তত ২৫ জন আহত হয়েছেন।

একাধিক মানবাধিকার সংগঠন থেকে প্রাপ্ত পরিসংখ্যানে এসব তথ্য জানা যায়। নিহতদের অধিকাংশই বিএনপির নেতাকর্মী। অধিকাংশ সংঘর্ষের ঘটনাই ঘটেছে বিএনপির নিজেদের মধ্যে।

অন্যদিকে গত এপ্রিল মাসের তুলনায় মে মাসে বিএনপির সঙ্গে জামায়াত ও ছাত্রদলের সঙ্গে শিবিরের উত্তেজনা ও সংঘর্ষ বৃদ্ধি পেয়েছে এবং বিএনপির সঙ্গে আওয়ামী লীগ ও এনসিপির সংঘর্ষ কমেছে উল্লেখ করা হয়েছে প্রতিবেদনগুলোতে।
ঘটনা বিশ্লেষণে দেখা যায়, আধিপত্য বিস্তার, কমিটি গঠন নিয়ে বিরোধ, চাঁদাবাজি ও বিভিন্ন স্থাপনা দখলকে কেন্দ্র করে অধিকাংশ সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে।

স্থানীয় পর্যায়ে কথা বলে জানা যায়, ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর বিএনপির নিজেদের মধ্যে বেড়েছে আধিপত্যের লড়াই। এতদিন যা কিছু ছিল আওয়ামী লীগের নিয়ন্ত্রণে, এখন সে সব কিছু বিএনপির দখলে নেওয়ার চেষ্টা করা হচ্ছে। আবার সব জায়গায়ই বিএনপির একাধিক গ্রুপ রয়েছে। অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি রাজনৈতিক আদিপত্যের লড়াই, সেই সঙ্গে আসন্ন নির্বাচনকে ঘিরে নিজেদের প্রভাব বলয় সৃষ্টি করতেই ঘটছে এসব সহিংসতার ঘটনা।

মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) প্রতিবেদনে দেখা যায়, জানুয়ারি থেকে এপ্রিল পর্যন্ত ৪ মাসে ২২৪টি রাজনৈতিক সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় প্রাণ হারান ৪৬ জন। যার মধ্যে ১৪১টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে বিএনপির নিজেদের মধ্যে। এসব ঘটনায় প্রাণ হারান বিএনপি ও এর সহযোগী সংগঠনের ৩২ নেতাকর্মী। এই সময়ে আওয়ামী লীগ-বিএনপির মধ্যে ২৩টি সংঘর্ষের ঘটনায় মারা যায় ৪ জন। বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে ১৩টি সংঘর্ষের ঘটনায় প্রাণ হারান ২ জন। বাকি ১২ জন প্রাণ হারান বিএনপি-আওয়ামী লীগের সহযোগী সংগঠনগুলোর মধ্যে সংঘর্ষের ঘটনায়।

মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস সাপোর্ট সোসাইটির (এইচআরএসএস) সাম্প্রতিক মানবাধিকার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত মে মাসে সারা দেশে ৬০টি রাজনৈতিক সহিংসতার ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন অন্তত ৯ জন এবং আহত হয়েছেন কমপক্ষে ৩৮১ জন। এসব সহিংসতার ঘটনার ৪৯টিই ঘটেছে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে এবং বিএনপির সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে। এর মধ্যে বিএনপির অন্তর্কোন্দলের ঘটনা ২৮টি, যাতে আহত হয়েছেন ২৫৯ জন ও নিহত হন ৫ জন।

নিহত ৯ জনের মধ্যে বিএনপির ৫ জন, আওয়ামী লীগের ৩ জন ও জামায়াতের ১ জন। ৬০টি সহিংসতার ঘটনার ৪৯টিই ঘটেছে বিএনপির অন্তর্কোন্দলে ও বিএনপির সঙ্গে অন্যান্য রাজনৈতিক দলের মধ্যে।

মে মাসে সহিংসতার ৬০টি ঘটনার মধ্যে বিএনপির অভ্যন্তরীণ কোন্দলের ২৮টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ২৫৯ জন ও নিহত ৫ জন, ১২টি বিএনপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ২১ জন ও নিহত ২ জন, ৬টি বিএনপি-জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষে আহত হয়েছেন ৬০ জন, ১টি আওয়ামী লীগ-জামায়াতের মধ্যে সংঘর্ষে জামায়াতের ১ কর্মী নিহত, এনসিপি-আওয়ামী লীগের মধ্যে সংঘর্ষের ৪টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ৪ জন, এনসিপি-জাতীয় পার্টির মধ্যে সংঘর্ষের ২টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ১২ জন, আওয়ামী লীগের অন্তর্কোন্দলে ২টি ঘটনায় আহত হয়েছেন ১১ জন এবং ২টি ঘটনা ঘটেছে বিভিন্ন দলের মধ্যে।

মানবাধিকার সংস্কৃতি ফাউন্ডেশনের (এমএসএফ) মে মাসের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, মে মাসে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতায় আটজন নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে বিএনপির অন্তর্দ্বন্দ্বে এক কিশোরসহ ছয়জন প্রাণ হারান। পাশাপাশি কার্যক্রম নিষিদ্ধ হওয়া আওয়ামী লীগের অন্তর্দ্বন্দ্বে এক কিশোর আর দলটির সঙ্গে সংঘর্ষে জামায়াতে ইসলামীর একজন নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া এ মাসে রাজনৈতিক সহিংসতার ৫৪টি ঘটনায় অন্তত ৩৫১ জন আহত হন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, ক্ষমতার দ্বন্দ্বের কারণেই রাজনৈতিক সংঘাতের সৃষ্টি হয়। আসন্ন জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে প্রত্যেক দলের সম্ভাব্য প্রার্থীই চেষ্টা করবেন দলের হাইকমান্ডের কাছে এলাকায় নিজের নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতাকে প্রদর্শন করতে। আর এসব করতে গিয়েই সম্ভাব্য প্রার্থীদের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়। এ ক্ষেত্রে বর্তমানে দেশের বড় দল হিসেবে বিএনপির প্রার্থীদের মধ্যে এ ধরনের সংঘাতের ঘটনা বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রেক্ষাপটে খুবই স্বাভাবিক ঘটনা, যদিও কখনোই তা কারও কাছে কাম্য নয়।

তিনি বলেন, এ ধরনের সংঘাত রোধ করতে দলের এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বড় ধরনের ভূমিকা আছে। যদিও ইতিমধ্যেই দলীয় শৃঙ্খলা ভঙ্গের অভিযোগে বিএনপি তার দলের শত শত নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নিয়েছে। তবে এ ধরনের সংঘাত রোধে এসব ব্যবস্থা যথেষ্ট নয়। বরং দল থেকে যদি ঘোষণা দেওয়া হয়, জনসাধারণের ক্ষতির বা হয়রানির কারণ ঘটতে পারে এমন কর্মকাণ্ডের সঙ্গে সম্পৃক্তদের নমিনেশন দেওয়া হবে না, তা হলে তা কার্যকর হতে পারে। কারণ নেতারা পদ-পদবীকে ভয় পান। সাংগঠনিক ব্যবস্থাকে তারা ভয় পান না। অন্যদিকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর উচিত হবে কোন দল ক্ষমতায় যাবে সেই দিক বিবেচনা না করে আইন ভঙ্গকারীদের বিরুদ্ধে জোরালো ভূমিকা গ্রহণ করা।

Sharing is caring!