প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৩রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৭শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

উচ্চপর্যায়ে অসন্তোষের গুঞ্জন, ভিন্ন এক ইরান দেখবেন খামেনি

editor
প্রকাশিত জুন ২৯, ২০২৫, ০৫:৫১ পূর্বাহ্ণ
উচ্চপর্যায়ে অসন্তোষের গুঞ্জন, ভিন্ন এক ইরান দেখবেন খামেনি

Manual4 Ad Code

নিউজ ডেস্ক:
ইরানের ইসলামি প্রজাতন্ত্রের সর্বোচ্চ নেতা, ৮৬ বছর বয়সী আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি, ইসরায়েলের সঙ্গে সংঘাত শুরুর পর থেকে কোনো এক অজ্ঞাত বাংকারে আত্মগোপনে আছেন। তবে রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনে প্রচারিত এক ভিডিও বার্তায় তিনি ১২ দিনের এই সংঘাতে ইরান বিজয়ী হয়েছে দাবি করে দেশবাসীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন এবং ইসরায়েলকে প্রায় চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দেওয়া গেছে বলেও উল্লেখ করেছেন।

Manual6 Ad Code

ইরান-ইসরায়েল যুদ্ধবিরতির পর প্রথমবারের মতো গত বৃহস্পতিবার তার এই ভিডিও বার্তা প্রকাশ পায়। ধারণা করা হচ্ছে, তিনি ইসরায়েলের হামলা থেকে বাঁচতে সম্পূর্ণ একাকী অবস্থায় কোথাও লুকিয়ে আছেন এবং বাইরের জগতের সঙ্গে খুব কম যোগাযোগ রাখছেন। এমনকি অনেক উঁচু পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তারাও তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছেন না বলে মনে হচ্ছে।

মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ও কাতারের আমিরের মধ্যস্থতায় একটি দুর্বল যুদ্ধবিরতি হলেও নিশ্চিতভাবে তাকে এখনো সাবধানতা বজায় রাখার পরামর্শ দেওয়া হবে। যদিও ট্রাম্প ইসরায়েলকে অনুরোধ করেছেন তারা যাতে ইরানের সর্বোচ্চ নেতাকে হত্যা না করে। তবে ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু হত্যার আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেননি। যদি এখন, অথবা পরে কখনো খামেনি আত্মগোপন থেকে বেরিয়ে আসেন, তখন তিনি মৃত্যু আর ধ্বংসের এক দৃশ্যের মুখোমুখি হবেন।

তিনি অবশ্যই আবার রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনের সামনে হাজির হবেন এবং ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ইরানের যুদ্ধে ইরানের জয়ের দাবিরও পুনরাবৃত্তি করবেন। তিনি নিজের ভাবমূর্তি আবার গড়ার চেষ্টা করবেন। কিন্তু তিনি এবার নতুন বাস্তবতার মুখোমুখি হবেন– সম্ভবত একটি নতুন যুগেরও।

বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এই যুদ্ধ ইরান সরকারের অবস্থানকে মারাত্মকভাবে দুর্বল করেছে এবং সাধারণ জনগণের কাছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা অনেক কমিয়ে দিয়েছে। যুদ্ধ চলাকালে ইসরায়েল খুব দ্রুত ইরানের আকাশসীমার বড় অংশের নিয়ন্ত্রণ নেয় এবং তাদের সামরিক স্থাপনাগুলোতে টার্গেট করে হামলা চালায়।

বিপর্যয়করভাবে বিপুল সংখ্যক রেভোলিউশনারি গার্ড ও সশস্ত্র বাহিনীর শীর্ষ কমান্ডার একের পর এক নিহত হন।

ইরানের মোট কী পরিমাণে সামরিক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে তা এখনো পরিষ্কার নয়, তবে বারবার আইআরজিসি এবং সেনাবাহিনীর বিভিন্ন ঘাঁটি ও স্থাপনায় বোমা হামলা থেকে বোঝা যায়, ইরানের সামরিক ক্ষমতা মারাত্মকভাবে দুর্বল হয়ে গেছে। ইরান তাদের এই সামরিক শক্তি ও গোয়েন্দা বাহিনীর পেছনে বহু বছর ধরে বিপুল সম্পদ ব্যয় করেছে।

ইরানের যেসব পারমাণবিক স্থাপনা প্রায় ২০ বছর ধরে মার্কিন ও আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞার মুখে ছিল এবং যেগুলোর পেছনে শত শত বিলিয়ন ডলার খরচ হয়েছে, সেগুলো এখন বিমান হামলায় ধ্বংস হয়ে গেছে– যদিও ক্ষতির পরিমাণ এখনো পুরোপুরি জানা যায়নি। এখন অনেকে প্রশ্ন তুলেছেন– এগুলোতে রাষ্ট্রীয় সম্পদের এত বিপুল বিনিয়োগ আর পারমাণবিক কর্মকাণ্ডের উদ্দেশ্যই বা কী ছিল?

Manual5 Ad Code

অনেক ইরানি বিশ্বাস করেন যে খামেনি, যিনি ১৯৮৯ সাল থেকে দেশটির নেতৃত্বে আছেন, তিনিই মূলত ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সংঘাতের জন্য দায়ী, যা শেষ পর্যন্ত ইরান ও তার জনগণের ওপর ব্যাপক ধ্বংস ডেকে এনেছে।

তারা তাকে দোষ দেন কারণ তিনি ইসরায়েলকে ধ্বংসের মতাদর্শিক লক্ষ্য অনুসরণ করেছেন, যে লক্ষ্য অনেক ইরানিই সমর্থন করেন না। আবার তিনি একটি বড় ভুল করেছেন বলেও তারা মনে করেন। তিনি ভেবেছেন, পারমাণবিক শক্তি অর্জন করলেই ইরানের সরকার অপরাজেয় হয়ে উঠবে।

কিন্তু একের পর এক নিষেধাজ্ঞা ইরানের অর্থনীতিকে ভেঙে ফেলেছে, যেটি এক সময় বিশ্বের অন্যতম বড় তেল রপ্তানিকারক দেশ ছিল, আজ তা এক দরিদ্র ও শক্তিহীন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে।

এমন তীব্র চাপের মধ্যে ইরান সরকার কতদিন টিকে থাকতে পারবে তা অনুমান করা কঠিন, কিন্তু এটি সম্ভবত এক শেষের শুরু, বলেন হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথি অধ্যাপক লিনা খাতিব।

Manual5 Ad Code

তিনি আরও বলেন, আলি খামেনিই সম্ভবত ইসলামী প্রজাতন্ত্রের শেষ ‘সুপ্রিম লিডার’ বা সর্বোচ্চ নেতা হবেন, অন্তত এই পূর্ণ মর্যাদার অর্থে।সরকারের সবচেয়ে উঁচু পর্যায়েও অসন্তোষের গুঞ্জন শোনা গেছে।

যুদ্ধের সবচেয়ে উত্তপ্ত সময়ে, ইরানের একটি আধা-সরকারি সংবাদ সংস্থা জানায় যে শাসকগোষ্ঠীর কিছু সাবেক উচ্চপদস্থ ব্যক্তি আলাদা অবস্থানে থাকা ধর্মীয় নেতা ও ইসলামি বিশেষজ্ঞদের প্রতি আহ্বান জানান, যাতে তারা দেশের নেতৃত্বে পরিবর্তন আনতে হস্তক্ষেপ করেন।

জবাবদিহির সময় আসবেই, বলেন স্কটল্যান্ডের সেন্ট অ্যান্ড্রুজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইরান স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের প্রতিষ্ঠাতা আলি আনসারি।

তিনি যোগ করেন, সুস্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছে যে সরকারের নেতৃত্বে বড় ফাটল তৈরি হয়েছে এবং সাধারণ মানুষের মধ্যে ব্যাপক অসন্তোষ রয়েছে।

গত দুই সপ্তাহে বহু ইরানি মিশ্র আবেগে ভুগেছেন। একদিকে দেশ ও মাতৃভূমি রক্ষার প্রয়োজনীয়তা, অন্যদিকে সরকারের প্রতি গভীর ঘৃণা। কিন্তু এই সময় তারা একত্রিত হয়েছেন সরকারকে নয়, বরং দেশ ও একে অপরকে রক্ষা করতে।

ইরান থেকে পাওয়া খবর অনুযায়ী, মানুষের মধ্যে গভীর সংহতি ও একাত্মতা তৈরি হয়েছে।

শহর থেকে বোমার আঘাতে পালিয়ে আসা লোকজনকে ঘরে আশ্রয় দিয়েছেন গ্রাম ও মফস্বলের মানুষরা। কিছু দোকানদার জরুরি পণ্য স্বাভাবিক মূল্যের চেয়ে কম দামে বিক্রি করেছেন, এবং প্রতিবেশীরা একে অপরের খোঁজখবর নিয়েছেন কারো কোনো সহায়তা প্রয়োজন কি না।

তবে অনেকে এটাও বুঝেছেন যে ইসরায়েল সম্ভবত ইরানের সরকার পরিবর্তনের চেষ্টা করছে, যে পরিবর্তন অনেক ইরানিও চান।
কিন্তু তাদের অনেকেই মনে করেন, এই পরিবর্তন দেশের ভেতর থেকে হওয়া উচিত, বাইরের দেশগুলোর চাপিয়ে দেয়ার প্রভাবে নয়।
আয়াতুল্লাহ খামেনি প্রায় ৪০ বছর ধরে, বিশ্বের অন্যতম দীর্ঘমেয়াদি স্বৈরশাসক হিসেবে তার দেশের মধ্যে যেকোনো ভিন্নমত দমন করে এসেছেন।

বিরোধী রাজনৈতিক নেতারা হয় জেলে আছেন, না হয় দেশ ছেড়ে পালিয়ে গেছেন। বিদেশে থাকা বিরোধী নেতারাও কোনো সুসংগঠিত অবস্থান নিতে ব্যর্থ হয়েছেন, যার কারণে তারা দেশের ভেতরের ও বাইরের ইরানিদের ঐক্যবদ্ধ করতে পারেননি।

এমনকি তারা কোনো প্রাথমিক বা সাধারণ সংগঠন তৈরি করতে পারেননি, যারা দেশের শাসনভার নেয়ার সুযোগ পেলে কাজ করতে পারতেন, অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতি সামাল দিতে পারতেন।

প্রায় দুই সপ্তাহ যুদ্ধ চলার সময়, যখন মনে হচ্ছিল সরকার ভেঙে পড়তে পারে, তখন অনেকেই মনে করেছিলেন, সরকার পড়ে গেলে বিরোধীরা দেশ চালাবে না, বরং দেশটা বিশৃঙ্খলা আর অরাজকতায় ডুবে যাবে।

Manual2 Ad Code

লিনা খাতিব বলেন, ইরানের বিরোধীরা ইরানি শাসনব্যবস্থার পতন ঘটাবে, এমন সম্ভাবনা খুবই কম। এই শাসনব্যবস্থা এখনো ভেতরে অনেক শক্তিশালী, আর প্রতিবাদ থামাতে তারা আরও কঠোরভাবে দমন চালাবে।

এখন অনেক ইরানির মধ্যে ভয় রয়েছে যে সরকারের দমননীতি আরও বাড়বে। ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অন্তত ছয়জনকে ইসরায়েলের হয়ে গুপ্তচরবৃত্তির অভিযোগে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে।একই অভিযোগে প্রায় ৭০০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন কর্মকর্তারা।

ইরান থেকে এক নারী বিবিসি পার্সিয়ানকে বলেন, যুদ্ধে মৃত্যু ও ধ্বংসের চেয়ে আমার কাছে আরও ভয়ঙ্কর হচ্ছে এমন একটি সরকার, যারা আহত ও অপমানিত হয়ে নিজেদের রাগ জনগণের ওপর ঝাড়ে। যদি সরকার ন্যূনতম পণ্য ও সেবা দিতে ব্যর্থ হয়, তবে মানুষের ক্ষোভ ও হতাশা আরও বাড়বে, বলেন আলি আনসারি।

তিনি আরও বলেন, আমি মনে করি, মানুষের মধ্যে অসন্তোষ ধীরে ধীরে বাড়বে, ধাপে ধাপে পরিবর্তন হবে। আমার মনে হয় না এই ক্ষোভ বা অসন্তোষ হঠাৎ করে সবার মাঝে ছড়িয়ে পড়বে। বরং বোমাবর্ষণ থেমে যাওয়ার অনেক পর তা শিকড় গাড়বে।

অনেক ইরানি বিশ্বাস করেন, গত মঙ্গলবার যে যুদ্ধবিরতি হয়েছে তা স্থায়ী হবে না। অনেকেই মনে করেন, ইসরায়েল এখনো থেমে নেই, বিশেষ করে এখন যখন তারা ইরানের আকাশ পুরো নিয়ন্ত্রণে রেখেছে। -বিবিসি

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code