প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২২শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৬ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বাংলাদেশে নাগরিকত্ব ছাড়ার হার বাড়ছে

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ১১, ২০২৪, ০৩:০২ অপরাহ্ণ
বাংলাদেশে নাগরিকত্ব ছাড়ার হার বাড়ছে

Manual3 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

নানা কারণে নাগরিকত্ব ত্যাগ করছেন বাংলাদেশিরা। অন্য দেশের নাগরিক হওয়ার জন্য বাংলাদেশিদের নাগরিকত্ব ছাড়ার হার দিন দিন বাড়ছে। একই সঙ্গে বাড়ছে বাংলাদেশি নাগরিকত্ব বহাল রেখে দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার হার। মূলত দেশের আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বেগের কারণে নাগরিকত্ব ত্যাগের হার বাড়ছে বলে পর্যবেক্ষকেরা মনে করছেন।

 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭ সালের ১০ জানুয়ারি থেকে ২০২৪ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ২ হাজার ৬০৬ জন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন। এই আট বছরে দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছেন ১৪ হাজার ৬৮৫ জন।

 

২০১৭ সালে ১১৯ জন, ২০১৮ সালে ৩৬৫ জন, ২০১৯ সালে ৩৫৬ জন, ২০২০ সালে ৩২৩ জন, ২০২১ সালে ১৬৫ জন, ২০২২ সালে ৪২১ জন, ২০২৩ সালে ৫৪৮ জন এবং ২০২৪ সালের ৬ নভেম্বর পর্যন্ত ৩০৯ জন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়েছেন। বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে ইউরোপের অন্যতম শীর্ষ অর্থনীতি ও প্রযুক্তির দেশ জার্মানির নাগরিকত্ব নেওয়ার হার সবচেয়ে বেশি। এর পরে আছে জার্মানিরই প্রতিবেশী অস্ট্রিয়া এবং পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশ সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়া।

 

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলছেন, মন্ত্রণালয় বিভক্ত হওয়ার পর নাগরিকত্ব পরিত্যাগের তথ্য হারিয়ে যায়। ফলে ২০১৭ সালের আগে কতজন বাংলাদেশি নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করেছেন, সে তথ্য সুরক্ষা সেবা বিভাগে নেই। তাঁদের ধারণা, ২০১৭ সালের আগে সংখ্যাটি এখনকার তুলনায় বেশ কম ছিল।

 

পছন্দের শীর্ষে জার্মানি

 

গত আট বছরে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে ৪০টির বেশি দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন বাংলাদেশিরা। গত আট বছরে ১ হাজার ২৮১ জন বাংলাদেশি জার্মানির, ৩৯২ জন অস্ট্রিয়ার, ১৮০ জন সিঙ্গাপুর, ১৫১ জন ভারত, ৬০ জন কোরিয়া, ৫৭ জন নরওয়ে, ২৫ জন যুক্তরাজ্য, ১৭ জন ইউক্রেন, ১৫ জন শ্রীলঙ্কা, ১৩ জন করে অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও ইরান; ১১ জন ইন্দোনেশিয়া ও ৯ জন বুলগেরিয়ার নাগরিকত্ব নিয়েছেন। এ ছাড়া পাকিস্তান ও মিয়ানমারের নাগরিকত্ব নিয়েছেন ৪ জন।

 

দ্বৈত নাগরিকত্ব ৩৩ হাজার

Manual4 Ad Code

 

১৯৮৮ সাল থেকে বাংলাদেশিদের দ্বৈত নাগরিকত্ব অনুমোদন শুরু করে সরকার। এখন পর্যন্ত ৩৩ হাজার ৮৭৫ জনের দ্বৈত নাগরিকত্ব রয়েছে। ১৯৮৮ সালে ২২৭ জনকে দ্বৈত নাগরিকত্ব দেওয়া হয়। সুরক্ষা সেবা বিভাগের তথ্যে ক্রমেই দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার তথ্য বাড়তে দেখা যায়। কয়েক বছরের ব্যবধান দিয়ে উপাত্তের দিকে তাকালে পাওয়া যায়: ১৯৮৯ সালে ৩১৫ জন, ২০০০ সালে ২৮৬ জন, ২০০৮ সালে ১ হাজার ১৮০ জন, ২০১৪ সালে ১ হাজার ৬৯৯ জন, ২০২০ সালে ১ হাজার ১৮৭ জন, ২০২২ সালে ১ হাজার ৭৮৬ জন এবং ২০২৩ সালে ৪ হাজার ১৩৩ জন বাংলাদেশি দ্বৈত নাগরিকত্ব নিয়েছেন।

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে অনেক দুর্নীতিবাজ ও নব্য ধনীর বিদেশে অর্থ পাচারের পাশাপাশি পরিবারের সদস্যদের বিদেশে পাড়ি জমানোর কথা জানা যায়। ওই সরকারের শেষ দিকে বাংলাদেশিদের আরও বেশি দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেওয়া হয়। ২০২৩ সালের ৭ ফেব্রুয়ারি বাংলাদেশিদের নতুন করে আরও ৪৪টি দেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব নেওয়ার সুযোগ করে দেয় মন্ত্রিসভা। এর আগে ৫৭টি দেশের নাগরিকেরা এ সুযোগ পেতেন। কয়েকটি শীর্ষ ব্যবসায়ী গোষ্ঠীর কর্ণধাররা নিজে কিংবা তাদের পরিবারের সদস্যরা বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ত্যাগ করে অন্য দেশের নাগরিকত্ব নিয়েছেন বা দ্বৈত নাগরিকত্বের অধিকারী বলে মিডিয়ায় ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছে।

Manual1 Ad Code

কোনো কোনো দেশের পাসপোর্ট পাওয়ার শর্ত হিসেবে আগের দেশের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে হয়। আবার কোনো কোনো দেশের পাসপোর্ট পাওয়ার পর নাগরিক হিসেবে শপথ নিতে হলে আগের নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে হয়। এ জন্য উল্লিখিত বাংলাদেশিরা নাগরিকত্ব ছেড়েছেন বলে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।

বর্তমান আইন অনুযায়ী, কোনো বাংলাদেশি অন্য দেশের পাসপোর্ট (অর্থাৎ নাগরিকত্ব) গ্রহণের পর বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব রাখতে না চাইলেও এ দেশে ৭৫ হাজার ডলার স্থায়ী বিনিয়োগ করে সহজেই স্থায়ীভাবে বসবাসের সুযোগ পান। সুরক্ষা সেবা বিভাগের একজন কর্মকর্তা বলেন, কোনো বাংলাদেশি নাগরিকত্ব ত্যাগ করলেও তার পরবর্তী তিন প্রজন্মের বংশধরের বাংলাদেশের নাগরিকত্ব স্বয়ংক্রিয়ভাবে বহাল থাকবে।

সুরক্ষা সেবা বিভাগের নিরাপত্তা ও বহিরাগমন অনুবিভাগের উপসচিব আলীমুন রাজীব বলেন, ‘আইন অনুযায়ী বাংলাদেশিরা নাগরিকত্ব পরিত্যাগ করতে পারেন। ১০১টি দেশের নাগরিকেরা বাংলাদেশের দ্বৈত নাগরিকত্ব পান।’

Manual7 Ad Code

 

 

৪৫২ বিদেশি পেয়েছেন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব

 

১৯৮৮ সালে প্রথম ৪ জন বিদেশিকে নাগরিকত্ব দেয় বাংলাদেশ। ১৯৮৯ সালে নাগরিকত্ব পান ৩৩ বিদেশি। এরপর ২০০৩ ও ২০১০ সাল ছাড়া প্রতিবছরই কিছু না কিছু বিদেশিকে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে। এখন পর্যন্ত মোট ৪৫২ জন বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশের নাগরিকত্ব পেয়েছেন। তাদের বেশির ভাগই নাগরিকত্ব পেয়েছেন বৈবাহিক সূত্রে। দীর্ঘদিন ধরে বসবাসের কারণেও বেশ কয়েকজনকে নাগরিকত্ব দেওয়া হয়েছে।

 

Manual5 Ad Code

 

আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক পরিস্থিতিই কারণ

 

দেশের আর্থসামাজিক পরিস্থিতি, নিরন্তর রাজনৈতিক অস্থিরতা, দুর্নীতির কারণে আর্থিকভাবে সামর্থ্যবান ও উচ্চ দক্ষতার ব্যক্তিদের মধ্যে দীর্ঘ মেয়াদে বা স্থায়ীভাবে বিদেশে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে। সংবাদপত্রের প্রতিবেদন, বিভিন্ন জরিপ ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের পোস্টে মেধাবীদের বিদেশে শিক্ষা গ্রহণের পরও থেকে যাওয়া এবং দেশ থেকে সামর্থ্যবানদের বিদেশে পাড়ি জমানোর প্রবণতার চিত্র পাওয়া যায়। পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত সাম্প্রতিক লেখালেখি ও গবেষণায় দেখা গেছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আবহাওয়ার চরমভাবাপন্ন হয়ে পড়া, খাদ্যে ভেজালের দৌরাত্ম্য, শিক্ষার মানের অবনতি ইত্যাদির কারণেও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে বিত্তবানদের মধ্যে দেশ ছাড়ার ঘটনা বাড়ছে। বৈধ ও অবৈধভাবে অভিবাসী কর্মীদেরও একটি অংশ বিদেশে স্থায়ী হন।

 

ব্রিটিশ কাউন্সিলের উদ্যোগে ‘নেক্সট জেনারেশন বাংলাদেশ ২০২৪’ শীর্ষক এক গবেষণা প্রতিবেদনের ফল প্রকাশিত হয় ৬ নভেম্বর। এতে বলা হয়, বাংলাদেশের ৪২ শতাংশ তরুণ বেকারত্ব নিয়ে উদ্বিগ্ন এবং ৫৫ শতাংশ তরুণ দেশ ছেড়ে বিদেশে চলে যেতে আগ্রহী।

সার্বিকভাবে দেশে সুশাসনের অভাব থাকাতেই সুযোগ পেলে অনেকে দেশ ছাড়ছেন বলে মনে করেন শীর্ষ বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম ও ইয়ুথ ইনিশিয়েটিভ কর্মসূচির প্রধান শরিফুল ইসলাম হাসান। তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের উন্নয়নের যত গল্পই বলি না কেন, বাস্তবতা হচ্ছে সুযোগ পেলেই লোকজন দেশ ছেড়ে যেতে চান। এর একটা বড় কারণ হলো, সুশাসনের ঘাটতি। যখন কেউ দেখে যে, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা নেই, ক্রসফায়ার-গুম হচ্ছে, এসব কারণে নিজের বা সন্তানের ভবিষ্যতের চিন্তা করে তাঁরা দেশ ছাড়ছেন। রাজনীতিবিদ বা আমলারা যতই দেশের উন্নয়নের কথা বলেন না কেন, তাঁদের অনেকেই মনে করেন, দেশের আসলে ভবিষ্যৎ নেই। এ জন্য নিজের সন্তানদের বিদেশে পাঠান, নিজের বাড়ি-গাড়ি বিদেশেই করেন।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual4 Ad Code