
প্রজন্ম ডেস্ক:
স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশি পণ্য আমদানিতে ভারত সরকারের নিষেধাজ্ঞায় যে সংকট তৈরি হয়েছে তা দূর করতে দেশটির সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসতে চাচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এ জন্য সচিব পর্যায়ে বৈঠকের প্রস্তাব দিয়ে ভারত সরকারকে চিঠি দেওয়া হবে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে। ভারতের জবাব পেলে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে।বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে এমনটি জানা গেছে।
শনিবার (১৭ মে) ভারত সরকারের এ সিদ্ধান্ত জানার পর বিষয়টি সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে সমাধানের উপায় খুঁজছে অন্তর্বর্তী সরকার। ওই দিনের পর থেকে রফতানি উন্নয়ন ব্যুরো, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, ট্যারিফ কমিশনসহ সরকারের বিভিন্ন দফতরে প্রতিদিনই কোনো না কোনো মিটিং হচ্ছে।
দেশের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত এই বৈঠকে স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের পণ্য আমদানিতে ভারতের নিষেধাজ্ঞার ইস্যু নিয়ে আলোচনা হয় বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে।
গত কয়েক দিনে বিভিন্ন দফতরে দফায় দফায় বৈঠকের পর মঙ্গলবার বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতাদের নিয়ে একটি জরুরি ও রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। বৈঠকে ব্যবসায়ীদের পক্ষ থেকে চরম উদ্বেগ জানানো হয় ভারতের এ সিদ্ধান্তের ব্যাপারে। তারা জানিয়েছেন, দ্রুত এই সংকটের সমাধান করতে আলোচনার কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের তরফ থেকে পাল্টা কোনো ব্যবস্থা না দিয়ে দ্রুত আলোচনায় বসতে হবে।
বৈঠকে অংশ নেওয়া ব্যবসায়ী প্রতিনিধি ও ঊর্মী গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক আসিফ আশরাফ বলেন, ‘বৈঠকে আমরা জানিয়েছি সংকট সমাধানে আলোচনা করতে হবে ভারতের সঙ্গে। আলোচনা ছাড়া বিকল্প কোনো উপায় নেই। এ জন্য আমরা বিজিএমইএ, বিকেএমইএ, বিটিএমএসহ বড় সব ব্যবসায়ী সংগঠনের পক্ষ থেকে সরকারের কাছে আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেব। এতে আমরা প্রস্তাব করব, ভারত সরকার স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি বন্ধের যে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সেটি আপাতত তিন মাসের জন্য স্থগিত করার। যাতে দুই দেশের বাণিজ্যে যে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে তা কাটানো যায়।
তিনি আরও বলেন, সরকারের কাছ থেকে আমরা একটা ক্লিয়ারেন্স পেয়েছি- দুই দেশের ব্যবসায়ী পর্যায়ে বসার। আমরা ইতিমধ্যে ভারতের ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করেছি। যাতে তারা তাদের সরকারকে বিষয়টি নিয়ে চাপ দেয়। কারণ ক্ষতিগ্রস্ত তো তারাও হচ্ছেন।
ভারতের এ সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের বাণিজ্যের কী পরিমাণে আর্থিক ক্ষতি হবে সে বিষয়েও আলোচনা হয়েছে গতকালের বৈঠকে। স্থলবন্দর দিয়ে ভারতে ১ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রফতানি হয়। আমরা বলেছি, স্থলবন্দর যদি বন্ধ থাকে তা হলে এই বাণিজ্যের পুরোটাই ক্ষতিগ্রস্ত হবে, আমরা ভারতের বাজার হারাতে পারি। এ জন্য আমরা সরকারকে অনুরোধ করেছি, কূটনৈতিক পর্যায়ে আলোচনা করে দ্রুত সমাধান করতে। আপাতত সিদ্ধান্তটি তিন মাস স্থগিত রেখে এই সময়ের মধ্যে আলোচনার মাধ্যমে সিদ্ধান্তে আসা যাবে।
বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের বৈঠকে কি আলোচনা হলো : গতকাল বিকালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়সহ আরও কয়েকটি মন্ত্রণালয়ের সচিবদের সঙ্গে ব্যবসায়ী নেতাদের নিয়ে যে রুদ্ধদ্বার বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় সেখানে সবাই আলোচনার মাধ্যমে সংকট সমাধানের মতামত দিয়েছেন। ভারতের স্থল বাণিজ্যে বিধিনিষেধের প্রেক্ষিতে দিল্লির বিরুদ্ধে পাল্টা পদক্ষেপ নেবে না ঢাকা- এমন কথাও বলা হয়।
বৈঠক শেষে বাণিজ্য সচিব মাহবুবুর রহমান বলেন, ‘স্থলবন্দর হয়ে ভারতে কিছু পণ্য প্রবেশে নিষেধাজ্ঞা এলেও এ নিয়ে কোনো পাল্টা পদক্ষেপ নেবে না বাংলাদেশ। বরং দুই দেশের বাণিজ্য সচিব পর্যায়ের ‘জয়েন্ট বিজনেস প্ল্যাটফর্মে’ আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করা হবে।
তিনি বলেন, ‘আজকে আমরা এ বিষয়ে ব্যবসায়ীদের সঙ্গে বসেছিলাম, তাদের মতামতটা নিলাম। পরিস্থিতি আর যাতে অবনতি না হয় সে জন্য আমাদের প্রচেষ্টা থাকবে। এ বিষয়ে আজকে আমরা আমাদের ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে শুনলাম। এরপর আমরা আমাদের নীতিনির্ধারক ও সংশ্লিষ্ট উপদেষ্টাদের সঙ্গে আলোচনা করব। আমরা কোনো ধরনের রিটেলিয়েট কর্মসূচি নেব না, তারা এটি করেছে, আমরা তাদের সঙ্গে এনগেইজ হব।
এ ধরনের নিষেধাজ্ঞাকে দুই দেশের ব্যবসায়ীদের জন্য ক্ষতি হিসেবে উল্লেখ করেন বাণিজ্য সচিব। সমস্যার সমাধানে দুই দেশের মধ্যে সচিব পর্যায়ে একটি বৈঠক আয়োজনের চিন্তার কথাও জানান তিনি।
তিনি বলেন, ‘আমরা বলব যে এতে করে শুধু বাংলাদেশের ব্যবসায়ীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি, আপনাদের ব্যবসায়ীরাও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। কাজেই আসুন আমরা বসি, একটা সুরাহার পথ বের করি। ভারতের সঙ্গে আমাদের সেক্রেটারিয়েট পর্যায়ের একটা এস্টাবলিস্ট ফোরাম আছে। বৈঠকের প্রস্তাব দিয়ে গত সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে একটা চিঠি পাঠিয়েছি। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে চিঠিটি পাঠানো হবে। সেই চিঠির উত্তর এলে আমরা বুঝতে পারব যে কবে বসা যায়।’
গতকালের বৈঠকে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ড, বাংলাদেশ স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ, রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোসহ বিভিন্ন দফতরের প্রতিনিধি ছিলেন। এ ছাড়াও ব্যবসায়ী প্রতিনিধি হিসেবে এফবিসিসিআই, বিজিএমইএ, ভারত-বাংলাদেশ চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।
গত (১৭ মে) ভারতের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন ডিরেক্টরেট জেনারেল অব ফরেন ট্রেড (ডিজিএফটি) এক বিজ্ঞপ্তিতে জানায়, ‘বাংলাদেশ থেকে সব ধরনের তৈরি পোশাক কোনো স্থলবন্দর দিয়ে আমদানি করা যাবে না। এগুলো কেবল মুম্বাইয়ের নাভা শেভা ও কলকাতা সমুদ্রবন্দর দিয়ে আমদানি করা যাবে।’
ভারত থেকে স্থলবন্দর দিয়ে বাংলাদেশ সুতা আমদানি বন্ধ করার এক মাসের মাথায় বাংলাদেশ থেকে স্থলবন্দর দিয়ে তৈরি পোশাক, পণ্য, ফলমূলসহ অন্তত সাত ধরনের পণ্য আমদানিতে এ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে দেশটি। এসব পণ্যের মধ্যে আরও রয়েছে- প্রক্রিয়াজাত খাদ্য, কোমল পানীয়, সুতা, প্লাস্টিক ও পিভিসি সামগ্রী, কাঠের তৈরি ফার্নিচার ইত্যাদি। ভারত এখন কেবল কলকাতা ও মুম্বাই সমুদ্রবন্দর দিয়ে বাংলাদেশের পণ্য আমদানি করার সুযোগ দিচ্ছে।
অন্যান্য পণ্যের কথা উল্লেখ করে বিজ্ঞপ্তিতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশ থেকে কোনো ধরনের আমদানি আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরামের কোনো স্থল কাস্টমস হাউস ও শুল্ক স্টেশন বা ইন্টিগ্রেটেড চেকপোস্ট (আইসিপি) দিয়ে করা যাবে না।
ভিন্ন পন্থায় পণ্য পাঠাতে খরচ বাড়বে পাঁচগুণ : ভারত স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য আমদানি বন্ধ করায় বাংলাদেশের রফতানিকারকদের পণ্য রফতানিতে বাড়তি খরচ গুনতে হবে। এতদিন বাংলাদেশের রফতানিকারকরা কম সময়ে খুব সহজে স্থলবন্দর দিয়ে পণ্য পাঠাতে পারতেন। নিষেধাজ্ঞার ফলে একই পণ্য পাঠাতে চার থেকে ১৫ গুণের বেশি পথ পাড়ি দিতে হবে। খরচও বাড়বে চার-পাঁচগুণ।
নিষেধাজ্ঞার আগে দেশের প্রধান রফতানি পণ্য তৈরি পোশাক ভারতে যেত মূলত ঢাকা থেকে বেনাপোল স্থলবন্দর হয়ে কলকাতায়। এই স্থলপথের দূরত্ব প্রায় ৩৩৩ কিলোমিটার। এখন যেতে হবে সমুদ্রপথে। সে ক্ষেত্রে চট্টগ্রাম বন্দর ব্যবহার করে পণ্য পাঠালে ভারতের মুম্বাইয়ের নাভা সেবা বন্দর অথবা ঢাকার পানগাঁও কিংবা মোংলা বন্দর হয়ে কলকাতার হলদিয়া বন্দর পৌঁছাতে হবে।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে নৌপথে মুম্বাইয়ের নাভা সেবা বন্দরের দূরত্ব প্রায় ২ হাজার ৬৫০ নটিক্যাল মাইল। পানগাঁও কিংবা মোংলা থেকে কলকাতার হলদিয়ার দূরত্ব প্রায় ৭০ থেকে ১০০ নটিক্যাল মাইল। পণ্য বন্দরে পৌঁছালে তারপর সেখান থেকে সেভেন সিস্টার্স কিংবা অন্য গন্তব্যে যেতে হবে আলাদা পরিবহনের মাধ্যমে। এতে প্রায় সপ্তাহখানেক সময় লাগবে, যা আগে এক দিনে করা যেত স্থলবন্দরের মাধ্যমে। সে ক্ষেত্রে স্থলপথের তুলনায় খরচ বাড়বে কয়েকগুণ। সময়ও লাগবে বেশি। এমনটাই বলছেন রফতানিকারকরা।
তৈরি পোশাক ছাড়াও স্থলবন্দর ব্যবহার করে খুব সহজে, কম সময়ে কম পথ পাড়ি দিয়ে কেক, চিপস, বিস্কুট, আসবাব, ড্রিংকস ও প্লাস্টিক পণ্য যেত ভারতে। সরাসরি রুটগুলো ছিল, ঢাকা-বাংলাবান্ধা-শিলিগুড়ি (পশ্চিমবঙ্গ) দূরত্ব প্রায় ৪৭৫ কিমি, ঢাকা-বুড়িমারী-কোচবিহার (পশ্চিমবঙ্গ) দূরত্ব প্রায় ৪৫১ কিমি, ঢাকা-আখাউড়া-আগরতলা (ত্রিপুরা) দূরত্ব প্রায় ১২৮ কিমি, ঢাকা-চাতলাপুর-করিমগঞ্জ (আসাম) দূরত্ব প্রায় ৩০৮ কিমি, ঢাকা-শেওলা-করিমগঞ্জ (আসাম) দূরত্ব প্রায় ২৮৮ কিমি এবং ঢাকা-তামাবিল-শিলং (মেঘালয়)-গৌহাটি (আসাম) দূরত্ব প্রায় ৪৬৮ কিমি।
নতুন নিষেধাজ্ঞার ফলে ঘুরে যেতে হবে বেশ লম্বা পথ। অতিরিক্ত পাড়ি দিতে হবে প্রায় চার থেকে ১৫ গুণ বেশি পথ। এখন যদি রফতানিকারকরা স্থলপথে পণ্য পরিবহন করতে চান সে ক্ষেত্রে ঢাকা-ভোমরা-কলকাতা-শিলিগুড়ি-গৌহাটি-করিমগঞ্জ-আগরতলা (১ হাজার ৯০০ কিমি প্রায়) কিংবা ঢাকা-সোনামসজিদ-শিলিগুড়ি-গৌহাটি-করিমগঞ্জ-আগরতলা (প্রায় ১ হাজার ৬০০ কিমি প্রায়) হয়ে তবেই পৌঁছাতে হবে। এতে যে কার্গো পরিবহনের ভাড়া ২০ হাজার টাকা লাগত সেটি এখন এক লাখ বা তার বেশি পড়বে। এত বেশি টাকা খরচ করে রফতানিকারকরা রফতানি কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়া নিয়ে শঙ্কায় আছেন।
Sharing is caring!