
প্রজন্ম ডেস্ক:
রাজনীতির আকাশে ঘনিয়ে উঠেছে অনিশ্চয়তার মেঘ। সংবিধান বাতিল, জুলাই সনদ, সেকেন্ড রিপাবলিক, গণভোট, নির্বাচন, সংস্কার, মুক্তিযুদ্ধ এবং উপদেষ্টা পরিষদ- প্রতিটি ইস্যুতে চলছে অভিযোগ, পাল্টা অভিযোগ। বিএনপি, এনসিপি ও জামায়াত এখন মুখোমুখি। দিন দিন এক দলের সঙ্গে আরেক দলের মতবিরোধ বাড়ছে। সম্প্রতি বিএনপি ও এনসিপি ছয়জন উপদেষ্টার পদত্যাগ দাবি করেছে। এতে রাজনৈতিক সমীকরণে জটিলতা দেখা দিয়েছে। অন্তর্বর্তী সরকারের সাড়ে ৯ মাসে অভ্যুত্থানের শক্তিগুলোর মধ্যে মোটাদাগে বিভাজন বাড়ছে। নানা ইস্যূতে ঐকমত্যে পৌঁছতে পারছে না দলগুলা।
রাজনীতির মাঠে বিএনপি ও এনসিপি নানা কৌশলে একে অপরকে চাপে রাখার চেষ্টা করছে। এর আগে মুক্তিযুদ্ধ ও নির্বাচনের সময়সীমা নিয়ে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গেও দূরত্ব তৈরি হয় এই দুই দলে। বিএনপির সুরে কথা বলছে গণঅধিকার পরিষদও। রাজনীতিতে দিনকে দিন একা হয়ে পড়ছে এনসিপি। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর দলগুলো একই সুরে কথা বললেও সময় বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে বাড়ছে দূরত্ব; সেই সঙ্গে বাড়ছে পরস্পরকে দোষারোপ করার প্রবণতাও। অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের ছয়জনের ভূমিকা নিয়ে প্রশ্ন তুলছে বিএনপি ও এনসিপি। সরকারের দুই ছাত্র উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া, মাহফুজ আলম এবং নিরাপত্তা উপদেষ্টা ড. খলিলুর রহমানের পদত্যাগের দাবি জানিয়েছে বিএনপি। আর অর্থ উপদেষ্টা সালেহ উদ্দিন আহমেদ, পরিকল্পনা উপদেষ্টা ড. ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ ও আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। এই তিন উপদেষ্টাকে ‘বিএনপিপন্থি’ অ্যাখায়িত করে তাদের পদত্যাগ দাবি করেছে এনসিপি। তারা সংস্কারের পথে বাধা বলে মত এনসিপির। এমন অবস্থায় রাজনৈতিক অঙ্গনে এক ধরনের অস্থিরতা বিরাজ করছে। নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নে স্পষ্ট অবস্থান নেই কোনো পক্ষেরই। বরং যাদের ঘিরে অভ্যন্তরীণ ভারসাম্য রক্ষার প্রত্যাশা ছিল, সেই শক্তির মধ্যেই এখন দেখা দিচ্ছে ফাটল।
রাজনৈতিক দলগুলোর মতবিরোধ সংস্কার কার্যক্রমে ভাটা ফেলতে পারে বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। তাদের মতে, মতবিরোধ থাকতেই পারে, কিন্তু তা যদি বিপরীতমুখী হয়ে যায়, তাহলে তা রাষ্ট্রের সংস্কার প্রক্রিয়াকে থামিয়ে দেবে। যেকোনো বড় পরিবর্তনের জন্য রাজনৈতিক ঐকমত্য দরকার। আর সেই ঐকমত্য গড়ে তোলার জায়গাটিতেই এখন সবচেয়ে বড় সংকট। রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক অবিশ্বাস ও প্রতিহিংসার রাজনীতি চলতে থাকলে নির্বাচন যেমন অনিশ্চিত হবে, তেমনি সংস্কারের আশাও ফিকে হয়ে পড়বে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, রাজনৈতিক বিষয়ে মতবিরোধ থাকতে পারে। সেটা অন্যায় কিছু নয়। তবে মতবিরোধ যখন কঠোর হয়ে যায়, তখনই সমস্যা তৈরি হয়। রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য ঐকমত্য প্রয়োজন। রাজনৈতিক দলগুলো যত বেশি দ্বন্দ্বে জড়াবে, ততই তারা সেই ঐকমত্য থেকে সরে যাবে। ফলে সংস্কার বাস্তবায়ন কঠিন হয়ে পড়বে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বিভেদ থাকার কারণে সংস্কার ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছানো দিন দিন আরও কঠিন হয়ে যাচ্ছে। সংস্কার ইস্যুতে সবাইকে ঐকমত্যে আসতে না পারলে সংস্কার কর্মসূচির গতি থমকে যাবে।
উপদেষ্টাদের পদত্যাগের দাবির বিষয়ে কাজী মাহবুবুর রহমান বলেন, প্রত্যেকে তার নিজ নিজ অবস্থান থেকে দাবি তুলতে পারে। তবে সেটি কতটা যুক্তিসঙ্গত, সেটাই বিবেচ্য বিষয়। তারা কেন পদত্যাগের দাবি তুলছেন, তা তাদের প্রমাণ করতে হবে।
যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচন অনুষ্ঠিত হওয়া উচিত। নির্বাচন যদি এ বছরের ডিসেম্বর কিংবা আগামী বছরের জানুয়ারির মধ্যে হয়, তাহলে সেটাই হবে সবচেয়ে ভালো বলে মত দেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক কাজী মাহবুবুর রহমান।
রাজনীতিতে ছাত্রদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করছে না বিএনপি। এ বিষয়ে দলটির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, ছাত্ররা নতুন বাংলাদেশ বাস্তবায়নের স্বপ্ন দেখছে। তাদের সঙ্গে আমাদের দ্বন্দ্ব হবে কেন? তাদের শত্রু ভাবব কেন? বিএনপির বয়স ৪৭ বছর, কিন্তু ওদের (ছাত্র) দল এনসিপির বয়স ৪৭ দিনও হয়নি। আমরা রাজনীতিতে ছাত্রদের প্রতিদ্বন্দ্বী মনে করি না। তাহলে দ্বন্দ্বের প্রশ্ন আসবে কেন? সরকারের সঙ্গে বিএনপির দ্বন্দ্ব হতে পারে। কারণ সরকারই সব চাওয়া পূরণ করবে।
অভ্যুত্থানের সব শক্তির মধ্যে ঐক্য ধরে রাখতে এনসিপি কাজ করছে বলে জানিয়েছেন দলটির মুখ্য সমন্বয়ক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী। তিনি বলেন, দেশের স্বার্থে জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেওয়া সব শক্তির ঐক্য ধরে রাখা খুবই প্রয়োজন। ঐক্য ধরে রাখতে এনসিপি কাজ করে যাচ্ছে। নিজেদের মধ্যে ভুল বোঝাবুঝির নিরসন করে সবাই একমঞ্চে দাঁড়িয়ে দেশ পুনর্গঠনে আত্মনিয়োগ করব।
এখন যে আলোচনা, বিতর্ক হচ্ছে, নানামুখী আন্দোলন-কর্মসূচির কারণে জনদুর্ভোগ তৈরি হচ্ছে- নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গেই এ বিষয়টি কমে আসবে বলে উল্লেখ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও কূটনীতি-রাজনীতি বিশ্লেষক ড. ইমতিয়াজ আহমেদ বলেন, ‘যেহেতু এখন পর্যন্ত নির্বাচনের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ দেওয়া হয়নি, ফলে এক ধরনের শঙ্কা ও অস্বস্তি কারও কারও মধ্যে রয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে অনেকেই ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচন অনুষ্ঠানের পক্ষে বলছেন। গত দিনে সেনাপ্রধানও ডিসেম্বরের মধ্যেই নির্বাচনের বিষয়ে মত দিয়েছেন। অন্তর্বর্তী সরকারের তরফ থেকেও বলা হচ্ছে ডিসেম্বর থেকে জুনের মধ্যে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। ফলে এটা খুব বড় সময় নয়।’
তবে এটা সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নয় বলে মন্তব্য করে তিনি বলেন, ‘তারপরও অনেকের মধ্যে যে সংশয় ও প্রশ্ন দেখা দিয়েছে এবং নানামুখী আন্দোলন তথা দাবিদাওয়া নিয়ে অনেকে পথে নামছেন। এই অস্থিরতাও নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ বা রোডম্যাপ ঘোষিত হলে স্বাভাবিকভাবেই কমে আসবে। তখন রাজনৈতিক দলগুলো নির্বাচনমুখী হবে, জনগণমুখী হবে। দলগুলো নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়বে।’
তিনি বলেন, ‘আজকে হোক বা কালকে- নির্বাচন তো দিতেই হবে। নির্বাচন ছাড়া তো গণতন্ত্রে উত্তরণ সম্ভব নয়। আর যেহেতু সমস্যা দিন দিন জটিল থেকে জটিলতর হচ্ছে, সেক্ষেত্রে যত তাড়াতাড়ি নির্বাচনী রোডম্যাপ দেওয়া হবে, তত দ্রুত বিতর্ক কমে আসবে, জটিলতার অবসান হবে। সব দলই জনগণমুখী হবে। কারণ শেষ অবধি জনগণকেই তো বিচারকের ভূমিকা নিতে হবে। আর সেটা হবে নির্বাচনের মাধ্যমে। দেশের মানুষের মতো আন্তর্জাতিক মহলও নির্বাচনের দিকে তাকিয়ে। তাই যত দ্রুত সম্ভব নির্বাচনী প্রক্রিয়া শুরুর মাধ্যমে সকল অনিশ্চয়তার মেঘ কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।’
Sharing is caring!