
প্রজন্ম ডেস্ক:
সড়ক থেকে কোনোভাবেই সরানো যাচ্ছে না মেয়াদোত্তীর্ণ বাস-লেগুনার মতো যানবাহন। পুরোনো এসব যানবাহনের কারণে প্রতিনিয়ত বাড়ছে দুর্ঘটনা। একের পর এক ঝরছে তাজা প্রাণ। পাশাপাশি এসব যানবাহনের কারণে পরিবেশ দূষণও হচ্ছে। বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, এ পরিস্থিতিতে আসন্ন ঈদুল আজহায় সড়কে বিশৃঙ্খলা ও দুর্ঘটনা আরও বাড়বে।
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) ২০২৩ সালের মে মাসের এক প্রজ্ঞাপনে- বাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকারের ইকোনমিক লাইফ (অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল) নির্ধারণ করা হয়। এতে বলা হয়, বাসের অর্থনৈতিক আয়ুষ্কাল হবে ২০ বছর ও ট্রাক-কাভার্ড ভ্যানের ২৫ বছর। বিআরটিএর হিসাবে ঢাকাসহ সারা দেশে চলাচলকারী ৭৫ হাজারের বেশি বাস, মিনিবাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকলরির আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে, যা মেয়াদোত্তীর্ণ বা পরিত্যক্ত হিসেবে বিবেচিত। বিআরটিএর মতেও এসব পুরোনো যানবাহন দুর্ঘটনা বাড়ানোর পাশাপাশি মারাত্মক পরিবেশ দূষণ করছে।
বিআরটিএর তথ্য মতে, সারা দেশে নিবন্ধিত বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ৭৬ হাজার ২৮১টি। এর মধ্যে ২৮ হাজার ৭৬১টি বাস-মিনিবাসের বয়স ২০ বছরের বেশি। বিআরটিএর মতে, ৩৭ দশমিক ৭০ শতাংশ বাস-মিনিবাসই আয়ুষ্কাল পেরিয়ে গেছে। এ ছাড়া নিবন্ধিত ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও ট্যাংকলরির সংখ্যা ৩ লাখ ৭২ হাজার ১৭৪। এর মধ্যে ২৫ বছরের চেয়ে বেশি পুরোনো এ ধরনের যানবাহনের সংখ্যা ৪৬ হাজার ৪৮১। এমন প্রেক্ষাপটে গত ১ মে থেকে রাজধানীর সড়ক থেকে সব ধরনের মেয়াদোত্তীর্ণ বাস, মিনিবাস, ট্রাক, কাভার্ড ভ্যান ও লেগুনা তুলে নেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিআরটিএ। কিন্তু এখন পর্যন্ত বিআরটিএর এমন কোনো অভিযান দৃশ্যমান হয়নি। অভিযোগ রয়েছে, পরিবহন মালিকদের চাপে বিআরটিএ এবারও পিছু হটেছে।
এ বিষয়ে বিআরটিএর চেয়ারম্যান মো. ইয়াসীন বলেন, ‘আমরা যে ঘোষণা দিয়েছি, তা বাস্তবায়ন করবই। মেয়াদোত্তীর্ণ বাস মালিকদের বিষয়ে আর কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। এমন বাস সড়কে পেলে জব্দ করা হবে। সরকারের সিদ্ধান্তের কোনো ব্যত্যয় হবে না।’
এদিকে ঢাকার সড়কে যত বাস চলছে, তার মধ্যে ‘মাত্র ২০ শতাংশ’ বাসের মেয়াদ ফুরিয়েছে বলে দাবি করেছেন ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির দপ্তর সম্পাদক কাজী জুবায়ের মাসুদ। তিনি বলেন, ‘যেসব গাড়ি রংচটা বা যেগুলোর চেসিস ভেঙেছে, সেগুলোরও অনেক ইঞ্জিন এখনো ঠিকঠাক রয়েছে, ফলে এগুলো মেয়াদোত্তীর্ণ বলা যাবে না। এ ধরনের বাসগুলো মেরামতের পর রং করে আবার সড়কে নামবে। আর যেসব গাড়ির মেয়াদ ফুরিয়েছে সরকার সেগুলো ডাম্পিং করুক। পরিবহন মালিক সমিতিও চাইছে সড়কে আর কোনো মেয়াদোত্তীর্ণ বাস যেন না চলে।’
শুধু বাস, ট্রাক নয়; রাজধানীর বিভিন্ন সড়কে লেগুনার বেপরোয়া দৌরাত্ম্য দেখা যায়। শহরতলি ছাড়াও নগরীর প্রধান সড়কেও চলছে ফিটনেসবিহীন লক্কড়ঝক্কড় লেগুনা। বিআরটিএর হিসাবে ঢাকায় ৬৫টি রুটে এখন ১০ হাজার লেগুনা চলাচল করছে। যার মধ্যে কেবল ২ হাজার ৪৭৮টি লেগুনার নিবন্ধন আছে। ২০১৮ সালে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) এক ঘোষণায় ঢাকার সড়কে লেগুনা চলাচল নিষিদ্ধ করে। কিন্তু লেগুনা মালিক, চালকদের বিক্ষোভে সেই ঘোষণা কার্যকর করা যায়নি।
সম্প্রতি ঢাকার সোয়ারীঘাট, লালবাগ, ফার্মগেট, মোহাম্মদপুর, বাংলাবাজার, গুলিস্তানের গোলাপশাহ মাজার এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, অধিকাংশ লেগুনার চেসিস বা ইঞ্জিন ভাঙা। অনেক লেগুনা গাড়ির ব্রেক স্যুর সঙ্গে একটি লোহার তার হুইলের সঙ্গে যুক্ত। কোনো কোনো গাড়ির দরজা ভেঙে পড়ে যাওয়ার অবস্থা। গাড়িতে যে সিএনজি সিলিন্ডার সেটিও বিপজ্জনকভাবে রাখা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ অটোরিকশা হালকা যান পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক গোলাম ফারুক বলেন, ‘অনেক লেগুনার মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়েছে এবং ফিটনেস বিহীনভাবেই চলাচল করছে, এটা সঠিক। আমরা চাইলেও সড়কে নতুন লেগুনা নামাতে পারছি না। তার কারণ, সিটি করপোরেশন বা বিআরটিএ থেকে আমরা নিবন্ধন পাই না। ফলে পুরোনো লেগুনা চালাতে বাধ্য হচ্ছি। এ বিষয়ে কর্তৃপক্ষের ইতিবাচক সিদ্ধান্ত জরুরি।’
এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) অ্যাক্সিডেন্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটের পরিচালক অধ্যাপক ড. শামছুল হক বলেন, ‘সড়কে শৃঙ্খলা ফেরাতে হলে সব অবকাঠামোতেই বড় পরিবর্তন আনতে হবে। আমরা পরিবহন মালিকদের সঙ্গে বসে বাস রুট ঠিক করছি, কোন রুটে কোন গাড়ি চলবে, কীভাবে চলবে। কিন্তু বাস মালিকরা কখনো শৃঙ্খলায় আসতে চান না। একের পর এক প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, কিন্তু কোনো লাভ হচ্ছে না। এসব বিষয়ে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ঐকমত্য যেমন দরকার, তেমনিভাবে নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সড়ক যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ কাউকে লাগবে। আমলাতান্ত্রিক ব্যবস্থা দিয়ে কখনো সড়কে শৃঙ্খলা ফেরানো যাবে না।’
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপকমিশনার মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘রাজধানীতে ডিএমপির ট্রাফিক বিভাগ সড়কের শৃঙ্খলা ও ট্রাফিক আইন ভঙ্গের বিরুদ্ধে কাজ করে যাচ্ছে। মেয়াদোত্তীর্ণ, ফিটনেসবিহীন বা ট্রাফিক আইন অমান্যকারী যানবাহন ও চালকের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চলছে এবং চলবে।’
Sharing is caring!