
প্রজন্ম ডেস্ক:
আসন্ন ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেটে ঘাটতি মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩ দশমকি ৬ শতাংশে নামিয়ে আনার লক্ষ্য ধরা হচ্ছে, যা গত ১৪ বছরের মধ্যে সর্বনিম্ন। সরকারের ঋণ পরিশোধের চাপ কমাতে এ পরিকল্পনা নেওয়া হচ্ছে। এই সিদ্ধান্ত আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে সহায়ক ভূমিকা রাখবে বলে আশা প্রকাশ করছেন বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা।
যে অর্থবছর শেষ হতে যাচ্ছে, তাতে মূল বাজেটে ঘাটতি ধরা হয়েছে জিডিপির ৪ দশমিক ৬ শতাংশ, টাকার অঙ্কে যার পরিমাণ ২ লাখ ৫৬ হাজার কোটি টাকা। পরে তা সংশোধন করে এই ঘাটতি ৪ শতাংশে নামিয়ে আনা হয়। এর আগের অর্থবছরে বাজেট ঘাটতি ছিল ২ লাখ ৬১ হাজার ৭৮৫ কোটি টাকা, যা জিডিপির ৫ দশমিক ২ শতাংশ ছিল। অর্থ মন্ত্রণালয় সূত্র বলেছে, নতুন বাজেটে ঘাটতি কমিয়ে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা নির্ধারণের প্রস্তাব করা হচ্ছে, যা জিডিপির ৩ দশমিক ৬ শতাংশ। এর আগে ২০১০-১১ সাল থেকে ঘাটতি ছিল জিডিপির ৩ দশমিক ৮ শতাংশ।
জিডিপির সর্বোচ্চ ৫ শতাংশ ঘাটতি ধরে বাংলাদেশে বাজেট প্রণয়নের রেওয়াজ চলে আসছে। এতদিন তা মেনেই বাজেট ঘোষণা করে আসছিল বিগত সরকার। কিন্তু করোনার সময় এই নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে ঘাটতি ৬ শতাংশ ধরে দুটি বাজেট দেওয়া হয়। এর যুক্তি হিসেবে তখন বলা হয়, বেশি বেশি খরচ করে মন্দায় অচল অর্থনীতিকে চাঙা করার পদক্ষেপ। অর্থনীতিকরা একে স্টেগফ্লেশন বলে থাকেন।
সম্পদের সীমাবদ্ধতার কারণে অন্তর্বর্তী সরকার আয় বুঝে ব্যয় করবে। ফলে আগামী বাজেট হবে তুলনামূলক ছোট। এ জন্য ঘাটতি কম প্রাক্কলনের প্রস্তাব করা হচ্ছে বলে অর্থ মন্ত্রণালয়ের সূত্র জানায়। আগামী ২ জুন সোমবার অর্থ উপদেষ্টা ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ ২০২৫-২৬ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করবেন। এটি হবে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রথম বাজেটে। সংসদ না থাকায় এবারের বাজেট টিভিতে দেওয়া হবে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাজেট প্রণয়নের সঙ্গে সম্পৃক্ত অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা খবরের কাগজকে বলেন, নতুন বাজেটের প্রধান উদ্দেশ্য হলো দেশীয় এবং বৈদেশিক ঋণের চাপ কমানো, যাতে ঋণের দুষ্টচক্র থেকে বের হওয়ার পথ সহজ হয়।
উল্লেখ্য, বাজেটে যে ঘাটতি ধরা হয়, তা মেটানো হয় দেশীয় এবং বিদেশি উৎস থেকে সংগৃহীত ঋণের মাধ্যমে। এই ঋণের বিপরীতে সরকারকে প্রতিবছর মোটা অঙ্কের সুদ-আসল পরিশোধ করতে হয়। এতে ঋণের চাপ বাড়ছে। পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রতিবছর বাজেটে সুদ পরিশোধ বাবদ মোট বরাদ্দের ১৮ থেকে ১৯ শতাংশ ব্যয় হয়। বাজেটে একক খাত হিসেবে এই বরাদ্দ সর্বোচ্চ। যে অর্থবছরটি শেষ হতে যাচ্ছে, তাতে ঋণের সুদ পরিশোধ বাবদ বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ লাখ ১৩ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।
পরিকল্পনা উপদেষ্টা ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ সম্প্রতি উচ্চপর্যায়ের বৈঠকের পর সাংবাদিকদের বলেছেন, আগামী বাজেট হবে আর্থিক খাতে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনার বাজেট।
তিনি বলেন, ‘আমাদের উদ্দেশ্য হলো ঋণের জাল থেকে বের হওয়া। যেখানে বাজেটের একটি বড় অংশ ঋণের সুদ-আসল পরিশোধে ব্যয় হয়ে যায়।’
প্রথিতযশা এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ঋণের এই দুষ্টচক্র ভাঙতে হলে রাজস্ব আয় বাড়াতে হবে, তবে ব্যয়ও সীমিত রাখতে হবে।
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের সাবেক মহাপরিচালক ড. মোস্তফা কে মুজেরী বলেন, ‘আমাদের মতো দেশে ঘাটতি বাজেটই হয়। এই ঘাটতি কী দিয়ে মেটানো হচ্ছে, সেটিই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। আয় থেকে ব্যয় বেশি করতে হলে ঋণ নিতে হবে। এই ঋণ যদি ব্যাংক খাত থেকে বেশি নেওয়া হয়, তাহলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যাবে। এর ফলে বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাব পড়বে। আবার বিদেশি ঋণ বেশি নিলে তা পরিশোধে চাপ বাড়বে। কাজেই ঘাটতি মেটাতে সক্ষমতা রয়েছে কি না, সেটি বিবেচনায় নিতে হবে। ঋণ নেওয়ার পর যদি তা পরিশোধ করা না যায়, তাহলে সমস্যা তৈরি হবে। বাজেট বাস্তবায়ন ব্যাহত হবে। কাজেই ঘাটতি নির্ধারণে এসব বিষয়কে গুরুত্ব দিতে হবে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সরকার ঘাটতি পূরণের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ঋণের ওপর নির্ভর করেছে। এই নির্ভরতা মূল্যস্ফীতির চাপকে বাড়িয়ে তুলেছে, কারণ বিশ্বজুড়ে মূল্যস্ফীতি কমলেও বাংলাদেশে ২০২৩ সালের মার্চ থেকে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বমুখী প্রবণতা লক্ষ করা যাচ্ছে।
অর্থনীতিবিদরা বলেন, বাজেট ঘাটতি পূরণে ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীলতা হলে একদিকে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ কমে যায়, যা বিনিয়োগ কর্মসংস্থানে বিরূপ প্রভাব ফেলে। অন্যদিকে মূলস্ফীতিকে উসকে দেয়। এ থেকে পরিত্রাণ পেতে হলে অভ্যন্তরীণ রাজস্ব আহরণ বৃদ্ধির পাশাপাশি বিদেশি ঋণ বেশি আনার পরামর্শ দেন তারা। কারণ বিদেশি ঋণ সস্তা। ফলে সুদ পরিশোধে চাপ কম থাকে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, জিডিপির সঙ্গে তুলনা করে বাজেট ঘাটতি নির্ধারণ করা খুব একটা অর্থবহ নয়। দেখতে হবে এটা অর্জনযোগ্য কি না। টাকার অঙ্কটাই বিবেচনায় আনতে হবে। কারণ আমাদের জিডিপির হিসাবে গলদ রয়েছে। লক্ষ্য অর্জনযোগ্য কি না, সেটা বিচার করতে গেলে এর অর্থায়ন কীভাবে করা হবে তা গুরুত্বপূর্ণ। নতুন অর্থবছরের বাজেটে ২ লাখ ২৬ হাজার কোটি টাকা ঘাটতির প্রস্তাব করা হলে এর অর্থায়নের জন্য ব্যাংকঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়বে। কারণ চাইলেই বিদেশি ঋণ বাড়ানো সম্ভব নয়। আবার রাজস্ব আহরণে দুর্বলতা রয়েছে।
তিনি বলেন, ‘আমানতের প্রবৃদ্ধির হার ভালো নয়। এ অবস্থায় ব্যাংক-ব্যবস্থা থেকে বেশি ঋণ করা হলে বেসরকারি খাতে ঋণপ্রবাহ সংকুচিত হবে। কাজেই মূল্যস্ফীতির ওপর চাপ কমানো কিংবা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে টাকা ধার করার সুযোগ কমিয়ে ফেলা- এসব দিক বিবেচনা করে আমি মনে করি আগামী বাজেটে ঘাটতির পরিমাণ ছোট হওয়াটাই কাম্য।’
ঘাটতি বাজেট নিয়ে বিতর্ক
ঘাটতি না উদ্বৃত্ত বাজেট- এ বিতর্ক বহু পুরোনো। বিশ্বের প্রায় সব দেশেই বর্তমানে ঘাটতি বাজেট করা হয়। বাংলাদেশ শুরু থেকে এ নিয়ম অনুসরণ করে জাতীয় বাজেট ঘোষণা করে আসছে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও সাবেক অর্থসচিব (প্রয়াত) ড. আকবর আলি খান রচিত ‘বাংলাদেশে বাজেট অর্থনীতি ও রাজনীতি’ বইয়ে বলা হয়েছে, ‘ইতিহাস বলে বেশির ভাগ সময়ই রাজাদের অর্থাভাব ছিল। আয় ও বেশি ব্যয়ের ফলে আর্থিক অনটনের সমস্যা দেখা যেত।’
অর্থনীতিবিদরা বলছেন, ‘বিশ্বের প্রায় সব দেশেই এখন ঘাটতি বাজেট করা হয়। বাংলাদেশে বাজেট ঘাটতি সহনীয় থাকলেও করোনার অভিঘাতে তা বেড়ে যায়। এ ছাড়া আমাদের রাজস্ব-ব্যবস্থা অত্যন্ত দুর্বল, যে কারণে বাজেট অর্থায়নে ধার বা ঋণের ওপর নির্ভরশীলতা বাড়ছে।’
বিশ্বের খ্যাতনামা অর্থনীতিবিদদের মধ্যে অর্থনীতিতে ঘাটতির প্রভাব নিয়ে তর্ক আছে। যারা এর বিপক্ষে, তাদের মতে, বাজেট ঘাটতি ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য বোঝা সৃষ্টি করে। কারণ ঋণের প্রতিটি টাকা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে শোধ করতে হবে।
তাদের মতে, অর্থনীতিকে চাঙা করতে হলে করহার কমিয়ে বেসরকারি খাতকে সুবিধা দিতে হবে, যাতে তারা বিনিয়োগে উৎসাহিত হয়।
অন্যদিকে যারা ঘাটতি বাজেটের পক্ষে তাদের মতে, ঘাটতি হলেই মূল্যস্ফীতি হবে না। বরং ব্যয় বেশি করলে উৎপাদন কর্মকাণ্ড বেগবান হবে। ফলে অর্থনীতিতে প্রাণচাঞ্চল্য সৃষ্টি হবে। বাড়বে কর্মসংস্থান।
ড. আকবর আলি খান তার বইতে লিখেছেন, ‘বাজেট ঘাটতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। এই ঘাটতি শুধু দায় সৃষ্টি করে না। ঘাটতি দিয়ে যদি অবকাঠামো খাতে ব্যয় করা হয়, তাহলে আয়ও সৃষ্টি করতে পারে।’
Sharing is caring!