প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৯ই নভেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৪শে কার্তিক, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৮ই জমাদিউল আউয়াল, ১৪৪৭ হিজরি

পোশাক খাতে ছোট ইস্যু বড় সংকট

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ১২, ২০২৪, ০১:২৪ অপরাহ্ণ
পোশাক খাতে ছোট ইস্যু বড় সংকট

Manual5 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর দেশের বিভিন্ন খাতে অস্থিরতা শুরু হয়। অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে বৈষম্য নিরসনে নানা দাবি নিয়ে সড়কে অবস্থান নেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। সরকারি, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত, আধা-স্বায়ত্তশাসিতসহ সর্বত্র যেন হাহাকার। বিভিন্ন সরকারি সংস্থা ও অধিদপ্তরের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা রাস্তায় নামে দাবিদাওয়ার ফিরিস্তি নিয়ে। এসব দাবিতে চলছে অনশন, অবস্থান, মানববন্ধন ও সমাবেশ। যার আঁচ লেগেছে দেশের রপ্তানিতে বড় অবদান রাখা তৈরি পোশাক শিল্পেও। বকেয়া বেতনের দাবিতে আশুলিয়া, নারায়ণগঞ্জ এবং গাজীপুরের কয়েকটি কারখানা শ্রমিকরা কর্মবিরতি, কখনও সড়ক অবরোধ আবার কখনও সংঘর্ষে জড়িয়েছে।

 

 

তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে তৈরি পোশাক খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, শ্রমিকদের কিছু যৌক্তিক দাবি থাকলেও অনেক কারখানার শ্রমিকরা সড়কে নামছেন অযৌক্তিক দাবি এবং ছোট ছোট বিভিন্ন ইস্যু নিয়েও। আর এতে সংকট বড় হচ্ছে। নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে অর্থনীতিতে। দীর্ঘদিন ধরে মাসের ১৫ তারিখে বেতন নিয়ে সন্তুষ্ট থাকা শ্রমিকরা হঠাৎ মাসের প্রথম সপ্তাহে বেতনের দাবি করে কাজ বন্ধ রাখছেন। আবার এক কারখানায় শ্রমিক অসন্তোষের জেরে আগুন দেওয়া হয়েছে পাশের কারখানাগুলোতে, যেখানে বেতন-ভাতার কোনো সমস্যা নেই। ফলে পোশাক খাতে অস্থিরতার পেছনে শুধু বকেয়া বেতনের ইস্যুটি সামনে এলেও এতে তৃতীয়পক্ষের উস্কানি আছে বলে সন্দেহ করছেন তারা। উস্কানিদাতাদের খুঁজে বের করে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনি পদক্ষেপ নেওয়ার দাবিও জানিয়েছেন শিল্প-উদ্যোক্তারা।

 

 

জানতে চাইলে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) সহসভাপতি ফজলে শামীম এহসান বলেন, ‘প্যালেস্টাইনে ইসরায়েলের আক্রমণ। তারপর ইউক্রেন- রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে বিশ্ব অর্থনীতি চাপের মুখে রয়েছে। এদিকে হুতি বিদ্রোহীদের কারণে সুয়েজ খাল বন্ধ। ফলে আমাদের ওপর যে অর্থনৈতিক চাপ তৈরি হয়েছে, তাতে কিছু কিছু কারখানা সময়মতো বেতন দিতে পারছে না। আবার বাইরে থেকে উস্কানিও আছে। আগে মাসের ১৫ তারিখ বেতন দিলে শ্রমিকরা কিছু বলত না। এখন মাসের ৭ তারিখে বেতনের দাবিতে শ্রমিকরা কাজ বন্ধ রাখছে। ফলে কারখানাগুলো আরও বেশি অর্থনৈতিক সমস্যার মধ্যে পড়ছে।’

 

সংকটে মালিকপক্ষের সংগঠনগুলো কী ভূমিকা পালন করে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তৃতীয়পক্ষের উস্কানিতে কোথাও মারামারি হলে সেখানে আমাদের খুব বেশি কিছু করার থাকে না। আর যেখানে মালিকপক্ষ দোষী থাকে, যেমনÑ বেতন দিতে পারছে না বা অনেক দিন ধরে বেতন-ভাতা বকেয়া, সেখানে আমরা সংগঠন থেকে মালিকপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করি, তাদের সম্পত্তি বিক্রি করা বা তাদের হার্ডলাইনে গিয়ে শ্রমিকদের বেতনের বিষয়টা সমাধান করি।’

 

তৃতীয়পক্ষের উস্কানির বিষয়ে বিস্তারিত জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘তৃতীয়পক্ষের উস্কানির একটা প্রমাণ হলো- সেদিন বেকার যুব সংঘ নামে একটা লোক ব্যানার নিয়ে কারখানায় ভাঙচুর করে বলছে আমাকে চাকরি দিতে হবে। চাকরির দাবি জানানোর জন্য তো আর ফ্যাক্টরি ভাঙা যায় না। তার মানে এখানে শ্রমিক নয়, বাইরের কোনো সমস্যা আছে। তারপর যেমন- বেক্সিমকো বেতন দিতে পারেনি বলে পাশের ফ্যাক্টরিতে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হলো। বেক্সিমকো বেতন দিতে পারেনি, তাতে পাশের ফ্যাক্টরিতে আগুন দিতে হবে কেন।’

 

জানা যায়, আশুলিয়ার কিছু কারখানায় শ্রমিকদের উস্কে দিয়ে দাবি আদায়ের পেছনে রয়েছে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর এর নিয়ন্ত্রণ নিতে চেষ্টা চালাচ্ছেন বিএনপির স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এ ছাড়া এতদিন যাদের নিয়ন্ত্রণে ছিল ঝুট ব্যবসা, তারাও চেষ্টা করছেন ধরে রাখতে।

 

Manual6 Ad Code

কারখানা মালিক, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, শ্রমিক সংগঠনের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, মূলত ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ নিতে আশুলিয়া শিল্পাঞ্চলে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছিল একটি চক্র। যারা বিগত সরকারের আমলে ঝুট ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করত, তারাই বহিরাগতদের ভাড়া করে পোশাক খাতে অস্থিরতা সৃষ্টি করেছে। তবে বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে।

 

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক শ্রমিক সংগঠনের নেতা বলেন, কারখানার শ্রমিকরা এই আন্দোলনগুলোর পক্ষে ছিল না। তাদের আন্দোলনে নামানো হয়েছে। আন্দোলনে না গেলে সেই কারখানায় হামলা চালিয়েছে বহিরাগতরা। এমন অনেক ফুটেজ রয়েছে। এ ছাড়াও কিছু কারখানার কর্মকর্তাদের অবরুদ্ধ করে আন্দোলন করা হয়েছে তাদের পদত্যাগের দাবিতে।

 

শ্রমিকদের দাবিদাওয়া সংক্রান্ত সংকট নিরসনে তৈরি পোশাক মালিকরা কী ধরনের পদক্ষেপ নিচ্ছেন। সেই সঙ্গে এ অস্থিরতা নিরসনের সরকারের দিক থেকে কীভাবে সহযোগিতা পাচ্ছেন- এ বিষয়গুলো জানতে চাইলে গার্মেন্টস মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সাবেক পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘বিগত তিন-চার মাস ধরেই আমরা সংগঠনের পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ে কাজ করছি। সরকারের সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কাজ করছি। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে কাজ করছি। আশার কথা হলো, আমরা আস্তে আস্তে সমস্যাগুলোর সমাধান করে আসছি।’

 

তিনি বলেন, ‘বেতন-ভাতা সংক্রান্ত সমস্যা যেটা হচ্ছে, সেটা মূলত একটি গ্রুপের কারখানায় ছিল। তাতে কিছু অস্থিরতা হয়। পরবর্তীকালে ওই কারখানার শ্রমিকরা অন্য কারখানায় যেখানে কোনো সংকট নেই- সেখানেও অস্থিরতা সৃষ্টির চেষ্টা করে। এতে বোঝা যাচ্ছে সমস্যাটা শুধু বেতন-ভাতা সংক্রান্ত নয়। যদি এমন হতো যে, আমাদের ২০টা কিংবা ৫০টা ফ্যাক্টরি বেতন দিচ্ছে না। বকেয়া রয়ে গেছে, তখন বলতে পারেন বেতন-ভাতার জন্য সংকট হচ্ছে। এত বড় শিল্প খাতে একটা-দুইটা কারখানা যেকোনো বিপদ-আপদে পড়তেই পারে। সবার তো সক্ষমতা সমান না। কিছু কিছু কারখানা সমস্যায় পড়তেই পারে। সে ক্ষেত্রে সংগঠন আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছে। সরকারও আন্তরিকভাবে এগিয়ে এসেছে।’

 

তার মতে, একটা-দুটো বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটতে পারে। কিন্তু সেটাকে কেন্দ্র করে ৫০টা কারখানার শ্রমিককে রাস্তায় নামিয়ে ফেলা কিংবা সেটা দিয়ে অরাজকতা বা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা কোনো মতেই কাম্য নয়। এ রকম যদি কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়, তাহলে তিনি আশা করছেন তাদের যথাযথ আইনের আওতায় আনার ব্যবস্থা হবে। কেননা সরকার, মালিক কিংবা শ্রমিক কেউই চায় না কারখানা বন্ধ থাকুক।

 

Manual1 Ad Code

এত এত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে কীভাবে দেশের তৈরি পোশাক খাত এগিয়ে যাবে জানতে চাইলে আত্মবিশ্বাসের সঙ্গে মহিউদ্দিন রুবেল বলেন, ‘আমরা যদি নিরবচ্ছিন্নভাবে কারখানা পরিচালনা করতে পারি, তাহলে নির্দ্বিধায় বলতে পারি, আমাদের ভবিষ্যৎ ভালো। বিগত কয়েক মাসে আমাদের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি কম ছিল, কিন্তু আমরা আস্তে আস্তে ইতিবাচক ধারায় ফিরছি। নিরাপত্তার পাশাপাশি আমরা যদি জ্বালানি সমস্যার সমাধান করতে পারি, সেই সঙ্গে আমাদের যে আর্থিক সংকটগুলো আছে তার সমাধান করতে পারি। তাহলে চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে এগিয়ে যাবে দেশের তৈরি পোশাক খাত।’

 

সময়টা যেন আলাদিনের চেরাগের মতো

 

বকেয়া বেতন পরিশোধে কর্তৃপক্ষের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে ৫২ ঘণ্টা পর অবরোধ প্রত্যাহার করেছে টিএনজেড গ্রুপের শ্রমিকরা। ফলে গতকাল সোমবার দুপুর ২টার পর থেকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কের মালেকের বাড়ি দিয়ে যান চলাচল শুরু হয়েছে। শ্রমিকরা আন্দোলন শুরু করলে চরম দুর্ভোগে পড়েন সাধারণ মানুষ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা তাদের বুঝিয়েও মহাসড়ক থেকে সরাতে পারেননি। রবিবার ওই আন্দোলনে কয়েক যুবক আলাপচারিতা করছিলেন। তার মধ্যে আনোয়ার নামে একজন বললেন, বাংলাদেশ এখন আলাদিনের চেরাগ। কথাটির কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, আগে পর্দায় দেখতাম আলাদিনের চেরাগে ঘষা দিলেই সব দাবি পূরণ হয়ে যায়। এখন আমাদের অবস্থাও এমন; অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে একটু দাবি তুললেই, আন্দোলন করলেই পাওয়া যাচ্ছে। ফলে এই আন্দোলন বেড়ে চলেছে।

এ ছাড়াও কয়েক লাখ মানুষ রয়েছে যারা বেকার। এদের অধিকাংশই কাজ খুঁজছেন। কাজ না থাকায় তারা বিভিন্ন জায়গায় ঘোরাঘুরি করেন। ফলে শুধু শ্রমিক আন্দোলনের মতো কোথাও মানুষের জটলা দেখা গেলে সেখানে ব্যাপক লোকসমাগম হয়। আন্দোলনে যদি থাকে ২০০ লোক, উৎসুক মানুষ থাকে ৫০০ জন। ফলে মুহূর্তের মধ্যে আন্দোলন জমে যায়, রাস্তায় সৃষ্টি হয় তীব্র যানজট।

Manual6 Ad Code

 

 

অধিকাংশ শ্রমিক আন্দোলন চায় না

 

Manual3 Ad Code

গাজীপুরের অধিকাংশ কারখানায় বেতন-ভাতা নিয়ে শ্রমিকদের তেমন দাবিদাওয়া নেই। যা দাবি ছিল ইতোমধ্যে পূরণ হয়ে গিয়েছে। তবে দুয়েকটি কারখানায় আন্দোলনের কারণে আশপাশের কারখানা সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে। ফলে অধিকাংশ শ্রমিক এখন কোনো আন্দোলন চায় না। তারা শান্তিপূর্ণভাবে কাজ করতে চায়। তারা মনে করেন আন্দোলনের ফলে গার্মেন্টস সেক্টরের ক্ষতি হচ্ছে।

 

স্প্যারো অ্যাপারেলস কারখানার শ্রমিক ওমর ফারুক বলেন, ‘আমাদের কাজের জায়গা হলো এই গার্মেন্টস। আন্দোলনের কারণে সেটা ক্ষতিগ্রস্ত হলে আমরা আরও অসুবিধার মধ্যে পড়ে যাব। আন্দোলনে সব সময় দেখি তৃতীয় কোনো পক্ষের লোক ঢুকে যায়। যৌক্তিক দাবি থাকলে সমাধান খুঁজতে হবে। অবরোধ ও ভাঙচুর করা যাবে না।’

 

জাতীয় গার্মেন্টস শ্রমিক জোট বাংলাদেশের সাংগঠনিক সম্পাদক মো. আশরাফুজ্জামান বলেন, ‘গার্মেন্টস সেক্টরে অস্থিরতা সৃষ্টি করতে কারা ইন্ধন দিচ্ছে খুঁজে বের করতে হবে। ৫ আগস্টের পর থেকে শ্রমিকদের এসব উরাধুরা দাবির পক্ষে আমরা নেই। তারা ইচ্ছেমতো দাবি দিচ্ছে, তাদের কোনো নেতা নেই। তারা কোথা হতে ১৭ দাবি ২০ দাবি নিয়ে আসে নিজেরাও জানে না। তাদের সঙ্গে কথা বলতে গেলেও লোক পাওয়া যায় না।’

 

শ্রমিকনেতা ও অভ্যুত্থানকারী ছাত্র শ্রমিক জনতার সংগঠক আরমান হোসাইন বলেন, ‘আমরা শ্রমিকদের যৌক্তিক দাবির পক্ষে। পাশাপাশি কোনো শ্রমিক অপরাধ না করেও ছাঁটাই হোক- সেটিও কাম্য নয়। শ্রমিকদের বিভিন্ন সংগঠন রয়েছে, অনেক সংগঠন আছে নামে মাত্র। তাই ভুয়া সংগঠন যেগুলো আছে তাদের উদ্দেশ্য খারাপ। মূলত শ্রমিক সংগঠন শ্রমিকদের পক্ষে যেমন কাজ করে, তেমনি রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের যাতে ক্ষতি না হয়Ñ সেদিকেও খেয়াল রাখে।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual3 Ad Code