প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

৮ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৩শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৭ই জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন পরিস্থিতিতে অস্থিরতা

editor
প্রকাশিত নভেম্বর ২৬, ২০২৪, ১১:৩৮ পূর্বাহ্ণ
অভ্যুত্থান-পরবর্তী নতুন পরিস্থিতিতে অস্থিরতা

Manual6 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

 

৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকার পতনের পর জনমনে এক ধরনের প্রত্যাশা তৈরি হয়েছিল, দেশ এবার শান্ত হবে। কিন্তু সরকারবিরোধী আন্দোলনের আগুন পুরোপুরি নিভে যাওয়ার আগেই গত তিন মাস ধরে নতুন এক পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে। যে যেখান থেকে পারছে আন্দোলনের দাবি নিয়ে মাঠে নেমে পড়ছে। কোনো প্রতিষ্ঠানের ব্যক্তিকে অপসারণ, পরীক্ষা বাতিল, চাকরি স্থায়ীকরণের দাবি, চুরি-ডাকাতির প্রতিবাদে, এমনকি স্বজনের ভুল-চিকিৎসা হয়েছে- এমন অভিযোগেও রাস্তা বন্ধ করে দেওয়ার ঘটনা ঘটছে। নানা ধরনের ‘মব’ তৈরি করে বিচার কিংবা দাবি আদায়ের চেষ্টা চলছে।

Manual7 Ad Code

অনেকের মতে, অবস্থাটা এমন যে, সবাই স্বাধীন হয়ে গেছে। কেউ কারও কথা শুনতে চাইছে না। সব মিলিয়ে ‘নৈরাজ্যকর এক পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জনমনে নতুন করে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে। এমন পরিস্থিতিতে দেশের মানুষের মনোজগতে কোনো পরিবর্তন ঘটেছে কি না, সেই প্রশ্ন সামনে এসেছে। বলা হচ্ছে, দীর্ঘদিনের বিচারহীনতা ও বঞ্চনার সঙ্গে মানুষের প্রত্যাশার সমন্বয় যেমন হচ্ছে না, তেমনিভাবে ব্যক্তি ও গোষ্ঠীগত হিংসা-বিদ্বেষ প্রকাশের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার আকাঙ্ক্ষাও। সব মিলিয়ে মানুষের মধ্যে অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়ছে বলে সমাজ-বিশ্লেষকরা মনে করছেন।

মানুষের মধ্যে এই পরিবর্তনের একাডেমিক দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে ব্যাখ্যা দিয়েছেন আমেরিকান লেখক রবার্ট টেড গুর। যিনি রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের মূল কারণ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ে তার ‘হোয়াই ম্যান রেবেল বা মানুষ কেন বিদ্রোহ করে’ বইটিতে নানা তত্ত্ব তুলে ধরেছেন। সেই অনুযায়ী মানুষ প্রথমে সাধারণভাবে বিদ্রোহ করে। এই সাধারণ বিদ্রোহ পার হয়ে যাওয়ার পর পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন করে তাদের মধ্যে এক ধরনের বঞ্চনাবোধ তৈরি হয়।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. এ কে এম রেজাউল করিম মনে করেন, যখন কোনো বিপ্লব হয়, তখন এ রকম পরিস্থিতি দেখা দেয়। সরকারের গতিবিধির ওপর তা নির্ভর করে। গত ১৬ বছরের সবকিছু একটা ধারায় অভ্যস্ত ছিল। নতুন পরিস্থিতিতে হয়তো সব বিভাগ সহযোগিতা করছে না। এগুলো সরকারকে বেকায়দায় ফেলার কৌশল হওয়াটাও অসম্ভব নয়।

 

‘দ্বিতীয়ত, এসব কর্মকাণ্ডকে নিরপেক্ষভাবে দেখলে সব গ্রুপ রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত না-ও হতে পারে। তারা সরকারকে দুর্বল মনে করে নিজের স্বার্থ হাসিল করতে চায়। সেরকম যদি হয় তাহলে এটি ভালো লক্ষণ নয়’ যোগ করেন তিনি।

Manual1 Ad Code

 

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে দাবি-দাওয়া নিয়ে সরব বিভিন্ন পক্ষ। এ পর্যন্ত শতাধিক সংগঠনের পক্ষ থেকে হাজারের বেশি দাবি-দাওয়া জানানো হয়েছে। বিভিন্ন পেশার মানুষ কখনো বিক্ষোভ, কখনো রাজধানীর গুরুত্বপূর্ণ মোড় অবরোধ করেছেন। কোথাও কোথাও যানবাহনসহ বিভিন্ন স্থাপনায় ভাঙচুর করা হয়েছে। উদ্দেশ্য পূরণের চেষ্টা হয়েছে মবের মাধ্যমে। তারা মনে করছেন, শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর নতুন এই সরকারের কাছে দাবি আদায় করার মোক্ষম সময়। ফলে তাদের মধ্যে প্রত্যাশার বিপরীতে হতাশা, পারস্পরিক হিংসা-বিদ্বেষ, নানা পক্ষের উসকানি, সহিংস মনোভাব লক্ষ করা যাচ্ছে।

 

সমাজবিজ্ঞানীদের পাশাপাশি মানুষের মনোজগতের পরিবর্তনের বিষয়ে মন্তব্য এসেছে রাজনীতিবিদদের পক্ষ থেকেও।

 

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী সম্প্রতি বলেছেন, ‘শেখ হাসিনা পলায়ন করার পরে বাংলাদেশের সবার মনোজগতে একটা বিশাল পরিবর্তন ঘটেছে।’

 

রবার্ট টেড গুরের সঙ্গে সংযোগ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শান্তি ও সংঘর্ষ অধ্যয়ন বিভাগের চেয়ারম্যান (ভারপ্রাপ্ত) ড. সাজ্জাদ সিদ্দিকী বলেন, ‘মানুষ যখন দেখল সরকার পরিবর্তন হয়ে গেছে। আমাদের দাবি আদায় হয়ে গেছে। এখন আমাদের সবকিছু ন্যায়-অন্যায় স্পষ্ট হয়ে উঠবে। মানুষ ন্যায্যবিচার পাবে। আমার বঞ্চনাবোধ দূর হয়ে যাবে। তাদের মধ্যে আগে থেকেই ধারণা ছিল, সরকার পরিবর্তন হলে আমার দাবি মানা হবে। এ জন্য সবাই দাবি নিয়ে অগ্রসর হচ্ছে।’

Manual7 Ad Code

 

তিনি বলেন, ‘এখন যে নৈরাজ্য চলছে, এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা হিসেবে দেখি না। এটাই হওয়ার কথা ছিল। কারণ আমরা সমাজ, রাষ্ট্র গঠনে গুরুত্ব দিইনি। শুধু অবকাঠামো, মূলধন এসব নিয়ে ভেবেছি। এ জন্য স্বাধীনতার ৫৩ বছরেও পরমত-সহিষ্ণুতা এবং পারস্পরিক সম্মানের বিষয়টি গড়ে ওঠেনি ভালোভাবে। ভ্রাতৃত্ববোধ তৈরি হয়নি। শ্রেণিবিভেদ বজায় রেখেছি সব স্তরে। আমরা পশ্চিমা মূল্যবোধের ধারণ (লিবারেলিজম) বা নিজস্ব ধর্মীয়-সামাজিক মূল্যবোধ কোনোটাই সঠিকভাবে ধারণ করতে পারিনি। যখন বড় দাবি আদায় হয়ে যায় তখন মানুষের মধ্যে আত্মবিশ্বাস চলে আসে। এসব দাবি কঠোর হস্তে দমনের বিষয় নয়। তাদেরকে সামাজিক চুক্তির আওতায় কথা বলতে হবে।’

 

পর্যবেক্ষকদের মতে, অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে দাবি আদায়ে সহিংস, বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরি করা হয়েছে। সরকারি তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার দাবিতে রেললাইন অবরোধ করেন। সেখানে চলন্ত ট্রেনে ঢিল ছোড়ার ঘটনা ঘটে। রক্তাক্ত হন নারী ও শিশু। বিষয়টি নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যাপক সমালোচনা হয়েছে। চাকরিতে বয়কট করার দাবিও উঠেছে সেই কলেজের শিক্ষার্থীদের। গত দুই দিন সোহরাওয়ার্দী কলেজ, কবি নজরুল কলেজ, মাহবুবুর রহমান মোল্লা কলেজ, বুটেক্স, ঢাকা পলিটেকনিক্যাল ইনস্টিটিউটসহ একাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। ভাঙচুর করা হয়েছে ক্যাম্পাস। লুট করা হয়েছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মূল্যবান জিনিসপত্র। এক কলেজের শিক্ষার্থীরা অন্য কলেজের শিক্ষার্থীদের নির্বিচারে হামলা করেছে। লাঠি ও ধারালো জিনিস নিয়ে পাল্টাপাল্টি আঘাত করেছে। এ ছাড়া পত্রিকা অফিসের সামনে মব তৈরি করা হয়েছে। এর আগে সচিবালয়ে জিম্মি করে এইচএসসি পরীক্ষা বাতিল ঘোষণা করতে বাধ্য করা হয়েছে। রাজনৈতিক ও সামাজিক বিরোধ থেকে কাউকে কাউকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে।

Manual6 Ad Code

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আয়েষা মাহমুদা বলেন, ‘বিষয়টি একটা ট্রেন্ড হয়ে গেছে। একটার দেখাদেখি অন্যটা আসছে। কিন্তু এভাবে তো হবে না। সবকিছুর ক্ষতিকর এবং সুবিধাজনক দিক দেখতে হবে। যদি অযথা গ ণ্ডগোল করে তাহলে ফোর্স ব্যবহার করতে হবে।’

 

অপরদিকে দাবি আদায়কে কেন্দ্র করে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি তৈরির পেছনে উসকানি রয়েছে বলে মনে করেন উপদেষ্টা মাহফুজ আলম। গতকাল সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে তিনি লিখেন, ‘ছাত্রদের আজ সংঘাতের মুখে ঠেলে দিয়ে হত্যার মাধ্যমে ছাত্রদের বৈধতার সংকট হলে, যারা যারা লাভবান হবে, তারা সবাই এ উসকানি এবং প্রশাসনিক ব্যর্থতার সঙ্গে জড়িত। ধীরে ধীরে আমরা সবই বলব। আপনারা চোখ খুললেই দেখতে পাবেন। বাম এবং ডান মানসিকতার কতিপয় নেতৃত্ব বা ব্যক্তি গণ-অভ্যুত্থানে, পরবর্তী সময়ে সরকারে নিজেদের শরিকানা নিশ্চিত না করতে পেরে উন্মত্ত হয়ে গেছেন। তাদের উন্মত্ততা, বিপ্লবী জোশ এবং উসকানিমূলক কর্মকাণ্ড দেশটিকে অস্থির করে রেখেছে।’

 

বিশ্লেষকরা মনে করেন, ‘আমাদের সংস্কৃতিটা এমনভাবে গড়ে উঠেছে, যেখানে জিঘাংসা, হিংসা, পরশ্রীকাতরতা, বিদ্বেষ বা কাউকে ছোট করে, অপমান করে তৃপ্তি পাওয়া যায়। এটা সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে তৃণমূল পর্যন্ত বিস্তৃত হয়েছে। সামাজিকভাবে আমরা এগুলো কখনো চিহ্নিত করার চেষ্টা করিনি।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual8 Ad Code