প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৭ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২রা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৬শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাড়ছে উত্তেজনা

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ১৯, ২০২৫, ১২:১৭ অপরাহ্ণ
বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাড়ছে উত্তেজনা

Manual3 Ad Code

প্রজন্ম ডেস্ক:

৫ আগস্টের পর থেকেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে চলছে টানাপোড়েন। ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভারতে আশ্রয়, বন্যা, সীমান্ত হত্যা, সংখ্যালঘু নির্যাতনের অভিযোগ, ভিসা বন্ধ করে পরে সীমিত করা প্রভৃতি বিষয় নিয়ে দুই দেশের সম্পর্ক খুব স্বস্তির জায়গায় নেই। এরই মধ্যে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে ভারতের কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার চেষ্টা আগুনে যেন ঘি ঢালছে। যাতে সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সঙ্গে যোগ হয়েছে দুই দেশের সীমান্তবর্তী জনগণও।

অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই নজরদারি বাড়িয়েছে দুই দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনী। এর মধ্যে সীমান্তে বিভিন্ন ঘটনায় পাল্টাপাল্টি প্রতিক্রিয়াও জানিয়েছে দুই দেশের সরকার। সবমিলিয়ে দুই দেশের সীমান্ত নিয়ে আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় উত্তেজনা বিরাজমান। শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকে ভারত সীমান্ত ব্যবস্থাপনায় কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করছে। নজরদারির জন্য বৈদ্যুতিক যন্ত্র ও অত্যাধুনিক ক্যামেরা লাগাচ্ছে বলে অভিযোগ রয়েছে। যেখানে নদী বা অন্য কোনো কারণে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার সুযোগ নেই, সেখানে নজরদারির জন্য উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন ক্যামেরাসহ বিশেষ যন্ত্র স্থাপন করা হচ্ছে।

 

উত্তেজনার শুরু

Manual5 Ad Code

সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভারতে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়ার পর আওয়ামী লীগের সাড়ে ১৫ বছরের ক্ষমতার অবসান হয়। ক্ষমতাচ্যুত দলের অনেকে ভারতের সীমান্ত অভিমুখী হয় ক্ষোভ থেকে বাঁচতে। ভারতও সীমান্তে কড়াকড়ি করে। টহল বাড়ায়। সার্বিক পরিস্থিতিতে প্রথমে বাংলাদেশিদের ভিসা দেওয়া বন্ধ রাখে নয়াদিল্লি। কিছুদিন পর চিকিৎসা ও জরুরি কিছু ভিসা চালু করে, যা এখনো চলমান। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ, ভারতের গণমাধ্যমে সংঘবদ্ধ প্রোপাগান্ডার জেরে আগরতলায় বাংলাদেশ দূতাবাসে হামলার ঘটনা ঘটে। যদিও দুই দেশের পররাষ্ট্র সচিব পর্যায়ের বৈঠক এবং গত এক মাসের বিভিন্ন আলোচনায় মনে হয়েছে, খানিকটা সহজ হয়ে আসছে সম্পর্ক।

 

বেড়া দেওয়া নিয়ে নতুন উত্তেজনা

সম্প্রতি বাংলাদেশের কয়েকটি জেলার সীমান্তে বাংলাদেশের বর্ডার গার্ড (বিজিবি) ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর স্থাপনা নির্মাণ নিয়ে আপত্তি তোলার পর সীমান্তে নতুন করে উত্তেজনা তৈরি হয়েছে। বিশেষ করে চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও নওগাঁ জেলা সংলগ্ন সীমান্তের ভারতের দিকের অংশে বেড়া নির্মাণ নিয়ে বাংলাদেশ অংশ থেকে বাধা দেওয়া হয়। আর লালমনিরহাটের পাটগ্রাম উপজেলার দহগ্রামে সীমান্তে কয়েক দফায় বেড়া স্থাপনের চেষ্টা চালায় বিএসএফ। তবে বিজিবি সদস্যদের বাধার মুখে তা আর পারেনি।

 

হঠাৎ কেন সীমান্তে বিএসএফ এমন তৎপর হলো, তা নিয়ে চলছে আলোচনা। তাদের এ কার্যকলাপের ইঙ্গিতই বা কী, সেটা বোঝার চেষ্টা করছেন বিশ্লেষকরা।

 

 

সীমান্ত ইস্যুতে উত্তেজনার মধ্যেই ঢাকায় নিযুক্ত ভারতীয় হাইকমিশনার প্রণয় ভার্মাকে তলব করে কড়া প্রতিবাদ জানায় ঢাকা। সম্প্রতি পররাষ্ট্রসচিব মো. জসীম উদ্দিনের সঙ্গে আলোচনা করতে আসেন তিনি। পরে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া দেওয়ার ব্যাপারে দুই দেশের মধ্যে বোঝাপড়া রয়েছে। পরে ভারতে নিযুক্ত বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনার নূরুল ইসলামকে তলব করে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। দিল্লি ও ঢাকার মধ্যে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্যই তাকে ডাকা হয়।

 

জানা যায়, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান চার হাজার ১৫৬ কিলোমিটার সীমান্তের মধ্যে ৩ হাজার ২৭১ কিলোমিটার স্থানে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কাঁটাতারের বেড়া স্থাপন করেছে এবং ৮৮৫ কিলোমিটার স্থানে কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ করা হয়নি। সেসব স্থানেই ভারতের বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া দিতে চাইছে।

Manual1 Ad Code

 

চৌকা সীমান্তে প্রথমে বেড়া দেওয়ার চেষ্টা

Manual7 Ad Code

গত সপ্তাহে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার চৌকা সীমান্তের ওপারে ভারতের সুখদেবপুর সীমান্তে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণ নিয়ে উত্তেজনা সৃষ্টি হয়। ৮ জানুয়ারি চৌকা সীমান্তে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়।

আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী, সীমান্ত লাইন থেকে দেড়শ গজের মধ্যে কিছু করা হলে সেটা অপর পাশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীকে সঠিক নিয়ম মেনে অবহিত করতে হয়। কিন্তু ভারত ১০০ গজের মধ্যে মাটি খুঁড়লেও বিএসএফ বাংলাদেশের বিজিবিকে জানায়নি বলে জানান ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল গোলাম কিবরিয়া। পরে বিজিবি থেকে এ নিয়ে বাধা দেওয়া হয় এবং সাময়িকভাবে কাজ থামানো হয়। এদিন দুই দেশের সীমান্তের অধিবাসীদেরও বিজিবি-বিএসএফের সঙ্গে যোগ দিতে দেখা যায়। অতীতে এ ধরনের ঘটনা খুব দেখা যায়নি।

 

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাড়ছে উত্তেজনা

Manual2 Ad Code

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তে বেড়া দেওয়া স্থগিত করা ইস্যুতে বিএসএফ ১০ জানুয়ারি বলে, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে অরক্ষিত অংশগুলোতে বেড়া দেওয়ার কাজ আপাতত স্থগিত রাখা হচ্ছে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা এড়াতে।

 

সপ্তাহের ব্যবধানে ফের উত্তেজনা

চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার কালিগঞ্জ সীমান্তে ফের উত্তেজনা দেখা দিয়েছে। শনিবার (১৮ জানুয়ারি) সকাল থেকে সীমান্তে দুই দেশের নাগরিকরা অবস্থান নেন।

 

বাংলাদেশ সীমান্তের স্থানীয়রা জানান, বিএসএফ সদস্যরা হঠাৎ করেই কাঁটাতারের বেড়ার পাশে ৫০০-৬০০ ভারতীয়কে জড়ো করেন। এসময় তারা বাংলাদেশের ভেতরেও ঢুকে পড়েন। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে ভারতীয়দের ধাওয়া করেন বাংলাদেশিরা। এতে তাদের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধে। এসময় ভারতীয় নাগরিকরা একাধিক ককটেলের বিস্ফোরণ ঘটান। এছাড়া বিএসএফ সদস্যরা টিয়ারশেল নিক্ষেপ করেন।

 

মহানন্দা ৫৯ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল গোলাম কিবরিয়া বলেন, পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে। বিস্তারিত পরে জানানো হবে।
নওগাঁ সীমান্তেও বেড়া দেওয়ার চেষ্টা

একই ঘটনা ঘটে নওগাঁয়। জেলার ধামইরহাট উপজেলার বস্তাবর সীমান্তের ওপারে আন্তর্জাতিক সীমান্ত আইন লঙ্ঘন করে বিএসএফ কাঁটাতারের বেড়া নির্মাণে বাধা দেয় বিজিবি। পরে কাজ না করেই ফিরে যান বিএসএফের সদস্যরা। এমন পরিস্থিতিতে বিজিবি ও বিএসএফের মধ্যে ব্যাটালিয়ন কমান্ডার পর্যায়ে পতাকা বৈঠক ডাকা হয়।

 

পরে বিজিবির নওগাঁ-১৪ পত্মীতলা ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ ইকবাল হোসেন জানান, আইন অনুযায়ী সীমান্তের শূন্যরেখা থেকে ১৫০ গজের মধ্যে ফসল চাষ ছাড়া সীমান্তবর্তী কোনো দেশ তাদের সীমানায় বেড়া কিংবা কোনো স্থাপনা নির্মাণ করতে পারবে না। কিন্তু বিএসএফের সদস্যরা আন্তর্জাতিক আইন ভেঙে সীমান্তে স্থাপনা নির্মাণের চেষ্টা করেন।

সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের জিরো লাইন থেকে দেড়শ গজের মধ্যে ভারতকে কোনো কাজ করতে দেওয়া হবে না। এর মধ্যে তিনটি জেলার পাঁচটি সীমান্তে বিএসএফকে কাজ বন্ধ করতে বাধ্য করা হয়েছে। ২০১০-২৩ সাল পর্যন্ত ভারত সীমান্তে কিছু অসম কাজ করা হয়েছে, যেগুলো ভারতের করা উচিত হয়নি। কিন্তু আগের সরকার সে সুযোগ ভারতকে দিয়েছে।

১৬ ফেব্রুয়ারি বিজিবি-বিএসএফ মহাপরিচালক পর্যায়ে বৈঠক আগামী ১৬ ফেব্রুয়ারি বিজিবি-বিএসএফের মহাপরিচালক পর্যায়ের বৈঠক হবে বলে জানা গেছে। বৈঠকে সীমান্তে হত্যা, কাঁটাতারের বেড়াসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা হবে বলে জানিয়েছেন স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা।

উপদেষ্টা বলেন, আলোচনা করবো যাতে কাজগুলো বন্ধ করা যায়। সীমান্তে প্রচুর শক্তি আছে। জনগণ হলো বড় শক্তি।

 

বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বাড়ছে উত্তেজনা

বিশ্লেষকরা বলছেন, সীমান্তে ফেলানীসহ বিভিন্ন হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশিদের মধ্যে ক্ষোভের জন্ম দিয়েছে। বিএসএফের সাম্প্রতিক কার্যকলাপ এবং সীমান্তে নতুন পদক্ষেপের ফলে পরিস্থিতি আরও উত্তপ্ত হয়ে উঠতে পারে। দুই দেশের আলোচনার মাধ্যমে সীমান্ত ইস্যু আরও ফলপ্রসূ হতে পারে।

দুই দেশের সীমান্ত পরিস্থিতি নিয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোস্তাকিম বিন মোতাহার বলেন, ‘সম্প্রতি ভারত একটি সিগন্যাল পেয়েছে যে, কেউ ভারতের এ ধরনের আচরণ পছন্দ করছে না। বাংলাদেশের পটপরিবর্তনের ফলে ভারত ইতোমধ্যে ক্লিয়ার মেসেজ পেয়ে গেছে। এই বাস্তবতা ভারতের বোঝা দরকার। একইসঙ্গে বাংলাদেশেরও অনুধাবন করা দরকার ভারত সবচেয়ে নিকটস্থ দেশ, সবচেয়ে বেশি তাদের সঙ্গে সীমান্ত রয়েছে এবং ব্যবসাও রয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে আরও ফলপ্রসূ পদক্ষেপ নেওয়া যায়।’

‘শুধু সরকার একা নয়, এক্ষেত্রে রাজনৈতিক দলগুলো আলোচনার মাধ্যমে ভূমিকা পালন করতে পারে। ভারতকে এটা বোঝাতে হবে শুধু আমাদেরই তাদের দরকার না, তাদেরও আমাদের দরকার।’

সীমান্ত হত্যা প্রসঙ্গে প্রশ্ন করা হলে অধ্যাপক মোস্তাকিম বিন মোতাহার বলেন, ‘ভারতের সীমানা শুধু বাংলাদেশ নয়, অন্য দেশের সঙ্গেও রয়েছে। পাকিস্তানের সঙ্গে শুনি না সীমান্তে তাদের দেশের সদস্যকে ভারত হত্যা করেছে। শুধু বাংলাদেশের জনগণ অবৈধ ব্যবসা করে? বিষয়টা এমন নয়। ইতোমধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এসব বিষয় সহ্য করা হবে না- এমন মেসেজ ভারতকে দেওয়া হয়েছে।’

 

বিজিবির বক্তব্য

এ বিষয়ে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) উপ-মহাপরিচালক (যোগাযোগ) কর্নেল মোহাম্মদ শরীফুল ইসলাম বলেন, ‘আন্তর্জাতিক আইন অমান্য করে ভারত সীমান্তে কাঁটাতারের বেড়া তৈরি করতে চেয়েছে। আমরা জোর আপত্তি জানানোর ফলে তারা সেটা বন্ধ করেছে। স্থানীয় জনগণও এতে যোগ দিয়েছেন।’

বিজিবির এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সীমান্তে নজরদারি ও টহল বাড়ানো হয়েছে। চোরাচালান ও অবৈধভাবে সীমান্ত পারাপার রোধে টহলের পাশাপাশি সীমান্ত এলাকার জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়ানোর নানা কর্মসূচি নেওয়া হয়েছে। এতে সীমান্তে হত্যাও কিছুটা কমেছে।’

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual5 Ad Code