প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১৬ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
১লা পৌষ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৫শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

রেললাইনে যে যার মতো রাস্তা বানায়, প্রাণ যায় জনগণের

editor
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২৫, ১২:৪৫ অপরাহ্ণ
রেললাইনে যে যার মতো রাস্তা বানায়, প্রাণ যায় জনগণের

Manual2 Ad Code

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

সারাদেশে রেললাইনে দুই হাজার ৭৮৯টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে মাত্র ৫৬৪টিতে গেটম্যান রয়েছে। ক্রসিংগুলোর মধ্যে এক হাজার ৩২১টির কোনো অনুমতিই দেয়নি বাংলাদেশ রেলওয়ে। অনুমোদিত রেলক্রসিংয়ের মধ্যেও ৯০৪টিতে গেটম্যান নেই। যে যার খেয়ালখুশি মতো রেললাইন অতিক্রম (ক্রসিং) করে রাস্তা বানিয়েছে, তার বলি হচ্ছে সাধারণ জনগণ।

রেলওয়ে বলছে, খোদ সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান রেলওয়েকে না জানিয়ে লেভেল ক্রসিং তৈরি করছে। ফলে স্বাভাবিকভাবেই এসব ক্রসিংয়ে নেই কোনো গেটম্যান। দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্যক্তি উদ্যোগেও অনেকে লেভেল ক্রসিং তৈরি করেছেন। আবার খোদ রেলওয়ে থেকে যেসব ক্রসিংয়ের অনুমোদন আছে, সেসব ক্রসিংয়েরও অধিকাংশ স্থানে গেটম্যান নেই। ফলে ট্রেন এলেও সিগন্যাল দেওয়ার কেউ থাকে না।

 

গত ১৫ জানুয়ারি ফরিদপুরের বোয়ালমারী উপজেলার চতুল ইউনিয়নের মুন্সিবাড়ি রেল ক্রসিংয়ে ট্রেনের সঙ্গে শ্যালো ইঞ্জিনচালিত নছিমনের সংঘর্ষ হয়। নছিমনের চালক সুজন মিয়ার (২৪) মৃত্যু হয় এ ঘটনায়।

 

এর আগে ৭ জানুয়ারি দুপুর সোয়া ১২টার দিকে ফরিদপুর সদর উপজেলার গেরদা ইউনিয়নে মুন্সীবাজার কাফুরা রেল ক্রসিংয়ে রাজশাহী থেকে ঢাকাগামী মধুমতি এক্সপ্রেসের ধাক্কায় মাইক্রোবাসের ছয় যাত্রী নিহত হন। নিহতদের মধ্যে পাঁচজনের বাড়ি নারায়ণগঞ্জ। ফরিদপুরে বেড়াতে এসে তারা দুর্ঘটনার শিকার হন।

 

সারাদেশে এমন দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। তবে এর সমাধানে কার্যকর উদ্যোগ নিচ্ছে না কেউই। যোগাযোগ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মধ্যে সমন্বিত উদ্যোগ এবং ক্রসিং ব্যবস্থাপনা আধুনিকায়ন না হলে এসব দুর্ঘটনা কমানো সম্ভব হবে না।

Manual6 Ad Code

বাংলাদেশ রেলওয়ের তথ্য বলছে, পূর্বাঞ্চলে তাদের অনুমোদিত ৪৩৪টি লেভেল ক্রসিংয়ের মধ্যে গেটম্যান আছে ২৪৫টিতে, নেই ১৮৯টিতে। পশ্চিমাঞ্চলে এক হাজার ৩৪টি ক্রসিংয়ের মধ্যে গেটম্যান আছে ৩১৯টিতে, নেই ৭১৫টিতে। সব মিলিয়ে অনুমোদিত এক হাজার ৪৬৮টি ক্রসিংয়ের মধ্যে ৯০৪টিতেই গেটম্যান নেই।

 

সারাদেশে অননুমোদিত লেভেল ক্রসিং রয়েছে এক হাজার ৩২১টি। এর মধ্যে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের (এলজিইডি) ৪৫৮টি, এলজিইডির অর্থায়নে ইউনিয়ন পরিষদ নির্মিত ৫০২টি, সড়ক ও জনপথ অধিদপ্তরের (সওজ) ১২টি, সিটি করপোরেশনের ৫৪টি, উপজেলা পরিষদের ৯টি, পৌরসভার ১১৬টি এবং অন্যান্য ১৭০টি লেভেল ক্রসিং রয়েছে।

 

রেলওয়ে পুলিশ সূত্রে জানা যায়, ২০২৪ সালে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় ৯৯৮টি মামলা হয়েছে। মরদেহ উদ্ধার করা হয়েছে এক হাজার ১৭ জনের। এর মধ্যে পুরুষ ৭৯৪ এবং নারী ২২৩ জন। ট্রেন লাইনের ওপর বসে গল্প ও চলাচলের কারণে মৃত্যু হয়েছে ৫০৪ জনের। অসতর্কভাবে রেলওয়ে ক্রসিং পারাপারের চেষ্টার সময় মৃত্যু হয়েছে ২৭২ জনের। কানে ইয়ারফোন থাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয়েছে ৭৬ জনের। ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে মৃত্যু হয়েছে ২৩ জনের এবং অপমৃত্যু হয়েছে (মৃত্যুর সঠিক কারণ অজানা) ১৪২ জনের।

 

এর আগে ২০২৩ সালে ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যুর ঘটনায় মোট মামলা হয় এক হাজার ৫৪টি। মোট মরদেহ উদ্ধার করা হয় এক হাজার ৬৪ জনের। এর মধ্যে পুরুষ ৮২৬ এবং নারী ২৩৮ জন। ট্রেনলাইনের ওপর বসে গল্প ও চলাচলের কারণে মৃত্যু হয় ৫০২ জনের। অসতর্কভাবে রেলওয়ে ক্রসিং পারাপারের চেষ্টার সময় মৃত্যু হয় ৩৮৭ জনের। ট্রেনের ছাদ থেকে পড়ে ২৩ জন ও কানে ইয়ারফোন থাকায় ট্রেনে কাটা পড়ে মৃত্যু হয় ১৮ জনের। অপমৃত্যু হয় (মৃত্যুর সঠিক কারণ অজানা) ১৩৪ জনের।

 

 

 

 

রেলের আইন অনুযায়ী, কোনো প্রতিষ্ঠান লেভেল ক্রসিং তৈরি করতে চাইলে রেলওয়ের অনুমতি নিতে হবে। লেভেল ক্রসিংয়ের প্রয়োজন উপলব্ধি করে রেল অনুমতি দিলে ক্রসিং তৈরি থেকে শুরু করে গেটম্যানের বেতনসহ সম্পূর্ণ খরচ সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে। তবে ব্যয় নির্বাহ তো দূরের কথা, ক্রসিং তৈরির আগে অনুমতিই নেয় না অধিকাংশ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান।

এ বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ের মহাপরিচালক মো. আফজাল হোসেন বলেন, স্থানীয় কর্তৃপক্ষ যেমন, পৌরসভা, এলজিইডি, সিটি করপোরেশন এ ধরনের কিছু সরকারি বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানও আছে, যারা নিজেদের সুবিধার জন্য যেখানে সেখানে রেললাইনের ওপর দিয়ে রাস্তা নির্মাণ করছে। এসব রাস্তা নির্মাণে আমাদের কোনো অনুমতি নেওয়া হয়নি। রেলওয়ে আইনের নিয়মনীতি না মেনে তারা রাতারাতি রাস্তা তৈরি করে ফেলছে।

Manual3 Ad Code

 

এ পরিস্থিতির দায় কার? এমন প্রশ্নের জবাবে রেলওয়ের মহাপরিচালক বলেন, আইনগতভাবে আমাদের দায় নেই। কিন্তু রেলের বদনাম হচ্ছে। বদনামটা কিন্তু আপনারাই দিচ্ছেন। না জেনে দিচ্ছেন। প্রকৃত নিয়ম হচ্ছে অনুমতি সাপেক্ষে যে রাস্তা তৈরি করবে ব্যয়ভার তাকেই বহন করতে হবে। কিছু কিছু জায়গায় আমরা রেলখুঁটি দিয়ে ক্রসিং বন্ধ করে দিয়েছি। স্থানীয় লোকজন সেগুলো সরিয়ে ফেলে।

 

Manual1 Ad Code

 

তিনি বলেন, দশ বছর আগে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় সিদ্ধান্ত হয়েছিল কিছু ক্রসিংয়ের অর্থ সরাসরি অর্থ মন্ত্রণালয় থেকে রেলওয়েকে দেওয়া হবে। তবে সেই প্রজেক্ট শেষ। এখন সেসব লেভেল ক্রসিংয়ে যেসব গেটম্যান নিয়োগ দিয়েছি তাদের রাজস্ব খাতে নিতে পারছি না। আবার বেতনও দিতে পারবো না। আমরা এরকম সমস্যায় পড়েছি।

 

বাংলাদেশ রেলওয়ের অনুমোদনকৃত লেভেল ক্রসিংয়েরও অধিকাংশ স্থানে গেটম্যান নেই। এ বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে আফজাল হোসেন বলেন, কিছু ক্রসিং ছিল ব্রিটিশ আমলের। তখন জনসংখ্যা-যানবাহন কম ছিল। তখন রাস্তা তৈরি হয়েছে কিন্তু গেট ব্যারিয়ার নেই। এখন লেভেল ক্রসিংয়ের পাশে অনেক অবকাঠামো তৈরি হয়েছে। এগুলোকে আমরা বলি আনম্যানড লেভেল ক্রসিং। যে পার হবে দেখে-শুনে পার হবে। এ জায়গাগুলোতে গেট ব্যারিয়ার তৈরি করে জনবল দেওয়া দরকার।

 

রেলের মহাপরিচালক আরও বলেন, সমস্যা সমাধানের জন্য সরকারের প্রকল্প নেওয়া উচিত। এছাড়া এগুলো রক্ষণাবেক্ষণের জন্যও জনবল সমস্যার সমাধান হওয়া দরকার। জনগণের জানমালের নিরাপত্তার জন্য এটা বাধ্যতামূলকভাবে করতে হবে।

 

বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক ও দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. হাদিউজ্জামান বলেন, রেলের অনুমতি না নিয়ে এলজিইডি, সওজ, সিটি করপোরেশনসহ অনেক প্রভাবশালী ব্যক্তি রেললাইনের ওপর দিয়ে লেভেল ক্রসিং বানিয়েছে। দুর্ঘটনার দায় সেসব প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে। রেলকে দিলে হবে না। দুর্ঘটনা কমাতে লেভেল ক্রসিংয়ের প্রকৌশল টিমকে আরও মজবুত হতে হবে। লেভেল ক্রসিংয়ের ঠিক আগ মুহূর্তে নির্দিষ্ট দূরত্ব পরপর দুই থেকে তিনটি স্পিড ব্রেকার দিতে হবে।

 

তিনি বলেন, শীতকালে কুয়াশার কারণে চালক অন্যমনস্ক থাকেন। এজন্য লেভেল ক্রসিংয়ে স্পিড ব্রেকারের সঙ্গে আলো এবং শব্দের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে ক্রসিংয়ের কাছাকাছি এলে পর্যাপ্ত শব্দ পরিবহনের চালকের কান পর্যন্ত পৌঁছায়। ক্রসিংয়ের আশপাশে হাট-বাজার আছে। এসবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।

Manual7 Ad Code

এই যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ বলেন, সিগন্যাল অটোমেশনে যেতে হবে। আমাদের আশপাশের দেশ করে ফেলেছে। যদিও এতে খরচ বেশি। রেলে এত বিনিয়োগ! এই প্রয়োজনীয় জায়গায় বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। দুর্ঘটনার কারণে রেলের বদনাম হচ্ছে। সরকারি প্রতিষ্ঠানের উচিত রেলের আইন মেনে চলা। সরকারি অন্য প্রতিষ্ঠান ক্রসিং তৈরি করলে তার যাবতীয় খরচ ওই প্রতিষ্ঠানকে নিতে হবে। সমন্বিত পদক্ষেপ না নিলে দুর্ঘটনা বেড়েই যাবে।

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code