
প্রজন্ম ডেস্ক:
ছয় বছর পর গত ২১ নভেম্বর প্রকাশ্যে কোনো অনুষ্ঠানে দেখা গেছে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে। ঢাকা ক্যান্টনমেন্টের সেনাকুঞ্জে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের পাশের আসনে বসে তিনি উপভোগ করেন সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান। গত এক যুগের মধ্যে এই প্রথম সেনাকুঞ্জের বার্ষিক এ আয়োজনে উপস্থিত হন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতারাসহ উপস্থিত ছিলেন বিশিষ্টজনরাও।
বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে ২০১৮ সালে দুর্নীতির মামলায় কারাগারে যাওয়ার পর এই প্রথম কোনো অনুষ্ঠানে যোগ দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। দুই বছর কারাগারে থাকার পর ২০২০ সালের মার্চ মাসে সরকারের নির্বাহী আদেশে শর্তসাপেক্ষে সাময়িক মুক্তি পান খালেদা জিয়া। গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর রাষ্ট্রপতি দণ্ড মওকুফ করে তাকে মুক্তি দেন। সবশেষ ২০১২ সালে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়েছিলেন খালেদা জিয়া, তখন তিনি বিরোধীদলীয় নেতা ছিলেন। এরপর আর কখনো তাকে সেনাকুঞ্জের এমন আয়োজনে দেখা যায়নি।
খালেদা জিয়া সম্প্রতি মার্কিন ভিসা প্রসেসিংয়ের জন্য দূতাবাসে গিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেন এবং ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। গুলশানের বাসায় তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন সৌদি আরব ও চীনের রাষ্ট্রদূত এবং পাকিস্তানের হাইকমিশনার। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে প্যারেড গ্রাউন্ডের মধ্যমণি হিসেবেও উপস্থিত থাকতে পারেন খালেদা জিয়া এবং ওই দিন রাতে তিনি লন্ডনের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
দীর্ঘদিন পর খালেদা জিয়া প্রকাশ্যে কোনো কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার পর বেশ উজ্জীবিত বিএনপির নেতাকর্মীরা। দলীয় প্রধানকে বিভিন্ন কর্মসূচিতে দেখে তাদের মধ্যে সাহস ও আশার আলো সঞ্চার হয়েছে। বেড়েছে দলের নেতাকর্মীদের মনোবল। দলীয় প্রধানকে ‘আপসহীন’ অ্যাখ্যা দিয়ে তারা বলছেন, গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে খালেদা জিয়ার উপস্থিতি দেশ ও মানুষকে নতুন এক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখাচ্ছে। বিএনপি নেতারা বলছেন, যে খালেদা জিয়া পথহারা মানুষকে গণতান্ত্রিক দেশের স্বপ্ন দেখিয়েছিলেন, তার হাত ধরেই ফের গণতান্ত্রিক ধারায় ফিরবে দেশ।
খালেদা জিয়া সম্প্রতি মার্কিন ভিসা প্রসেসিংয়ের জন্য দূতাবাসে গিয়ে ফিঙ্গারপ্রিন্ট দেন এবং ভারপ্রাপ্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। গুলশানের বাসায় তার সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন সৌদি আরব ও চীনের রাষ্ট্রদূত এবং পাকিস্তানের হাইকমিশনার। ১৬ ডিসেম্বর মহান বিজয় দিবসে প্যারেড গ্রাউন্ডের মধ্যমণি হিসেবেও উপস্থিত থাকতে পারেন খালেদা জিয়া।
শারীরিক অসুস্থতা সত্ত্বেও খালেদা জিয়ার উপস্থিতিতে দেশের রাজনীতিতে ঐক্য ও গণতন্ত্রে ফেরার সুবাতাস বইছে বলে মনে করেন দলটির নেতাকর্মী ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা।
সেনাকুঞ্জে খালেদা জিয়ার উপস্থিতির ছবি ফেসবুকে শেয়ার করে রাষ্ট্রদূত মুশফিকুল ফজল আনসারি লেখেন, ‘কেবল দিনের সেরা ছবিই নয়; এর মাঝেই নিহিত বিপ্লবের স্পন্দন, দ্রোহের ডাক, ত্যাগ-তিতিক্ষার গল্প, আর অবর্ণনীয় দুঃখ পেরিয়ে বাংলাদেশের উজ্জ্বল আগামীর প্রতিশ্রুতি।’
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানী উপজেলার বাসিন্দা জাতীয়তাবাদী স্বেচ্ছাসেবক দলের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি সরদার মো. নুরুজ্জামান বলেন, ‘দীর্ঘ এক যুগ পর আবারও সেই সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। যেখানে তার বিচরণ ছিল একজন সেনাপ্রধানের স্ত্রী হিসেবে। একজন সেনানিবাসের বাসিন্দা হিসেবে সেখানে তিনি ছিলেন বহু বছর। অনেকবার এসেছিলেন প্রধানমন্ত্রী হিসেবেও। মাঝপথে এই আঙিনা থেকে অশ্রুসিক্ত চোখে বিতাড়িত হওয়া এবং কারান্তরীণ হওয়ার গল্প চুকিয়ে তিনি আবারও ফিরেছেন সশস্ত্র বাহিনী দিবসে বিজয়ের বেশে। রোগ শোকের ছেদ টেনে তার হাস্যোজ্জ্বল উপস্থিতি অনুষ্ঠানে অন্য মাত্রা যোগ হয়।’
নুরুজ্জামান আরও বলেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া বিএনপি তথা জাতীয়তাবাদী পরিবারের ভালোবাসা ও অহংকারের প্রতীক। আপসহীন নেত্রী হয়ে দেশবাসীর মনের গহীনে অনেক আগেই স্থান করে নিয়েছেন। ইনশাআল্লাহ তার পবিত্র হাতের ছোঁয়ায় বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে গণতান্ত্রিক ও আদর্শ রাষ্ট্র হিসেবে সুপ্রতিষ্ঠিত হবে সেই আশা ও প্রত্যাশা রাখছি।’
বগুড়ার বাসিন্দা ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি ফজলুর রহমান খোকন বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন গৃহবন্দি ছিলেন। এখন মুক্ত অবস্থায় রয়েছেন। তার চিকিৎসা দরকার। দেশনেত্রীর প্রকাশ্য উপস্থিতিতে আমরা দলীয় নেতাকর্মী এবং জনসাধারণ আশান্বিত হয়েছি। তিনি যে আপসহীন নেত্রী আবারও প্রমাণিত। দল ও দেশের হাল ধরবেন তিনি।’
‘খালেদা জিয়া এখন বাংলাদেশের মানুষের হৃদয়ে আসীন’ উল্লেখ করে নোয়াখালীর বাসিন্দা ও বিএনপির কেন্দ্রীয় সহ-পল্লী উন্নয়নবিষয়ক সম্পাদক বজলুল করিম চৌধুরী আবেদ বলেন, ‘তার ধারে কাছে কোনো রাজনীতিবিদ নেই। এতদিন বিএনপি খালেদা জিয়াকে দেশনেত্রী সম্বোধন করতো, এখন সেটা গোটা দেশের মানুষ করে। খালেদা জিয়ার সঙ্গে দেশনেত্রী শব্দটা সমর্থক হয়ে গেছে। তার এই অর্জন বহু ত্যাগ-তিতিক্ষার মধ্য দিয়ে। গণঅভ্যুত্থানের পর সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে রাজনীতিবিদ হিসেবে, গণতন্ত্রের জন্য সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত রাজনীতিক বা ব্যক্তি হিসেবে, গোটা জাতি তাকে সম্মানিত করেছে।’
পাবনার সাঁথিয়া উপজেলার বাসিন্দা বিএনপির কেন্দ্রীয় কার্যালয়ের কর্মকর্তা মো. সালাউদ্দিন বলেন, ‘জাতির কাছে আপসহীন নেত্রী খালেদা জিয়ার গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়েছে। জাতি উৎফুল্ল, আবার ওনাকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দেখতে চাই।’
খালেদা জিয়া এখন পুরো দেশের ঐক্যের প্রতীক উল্লেখ করে যশোরের কেশবপুরের বাসিন্দা ও ছাত্রদলের সাবেক কেন্দ্রীয় সভাপতি কাজী রওনাকুল ইসলাম শ্রাবণ বলেন, ‘খালেদা জিয়ার প্রকাশ্যে আসা এমন এক সময়ে হয়েছে, যখন পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার প্রয়োজন অনুভব করেছে, ঠিক তখনই মুক্ত খালেদা জিয়া। অসুস্থ অবস্থায়ও সেনাকুঞ্জে সশস্ত্র বাহিনী দিবসে উপস্থিত হয়ে পুরো জাতিকে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার বার্তা দিয়েছেন বলে আমি মনে করি। খালেদা জিয়া এখন আর শুধু বিএনপির ঐক্যের প্রতীকে সীমাবদ্ধ নন, তিনি এখন পুরো দেশের ঐক্যের প্রতীক।’
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা অ্যাডভোকেট সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন আলাল বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর মেঘের আড়ালে চাঁদ উঁকি দিলে যেমন লাগে, খালেদা জিয়ার প্রকাশ্যে উপস্থিতি মানুষের কাছে তেমন লাগছে। দেশের মানুষ তাদের প্রিয় নেত্রীকে যেভাবে দেখতে চায় সেভাবেই দেখছে।’
বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, খালেদা জিয়ার সেনাকুঞ্জে যাওয়ার এ ঘটনা গণতন্ত্র ফেরানোর আন্দোলনে ‘ইতিবাচক ভূমিকা’ রাখবে।
‘খালেদা জিয়া এখন দল-মত নির্বিশেষে সবার’ উল্লেখ করে ব্রিটিশ চলচ্চিত্র পরিচালক জুবায়ের বাবু বলেন, ‘বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে যথাযোগ্য মর্যাদায় সশস্ত্র বাহিনী দিবসের অনুষ্ঠানে সেনাকুঞ্জে নেওয়া হয়। এর আগে তিনি অনেকবার সেখানে গেছেন। কিন্তু এবারের যাওয়াটা একটু ভিন্ন। উনি কিন্তু এখন দল-মত নির্বিশেষে সবার। সমগ্র জাতির ঐক্য সেদিন হয়ে গেছে। এখন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক খালেদা জিয়া।’
রাজনৈতিক বিশ্লেষক মোবাশ্বের হোসেন বলেন, ‘জাতির অভিভাবক হিসেবে সশস্ত্র বাহিনীর হাত ধরে জনসমক্ষে এসেছেন খালেদা জিয়া। তিনি সেনাবাহিনীর আমন্ত্রণের প্রতি ভালোবাসার বহিঃপ্রকাশ দেখিয়েছেন। খালেদা জিয়া সেনা পরিবারের একজন সদস্য। দীর্ঘদিন উনাকে দূরে রেখেছে, কিন্তু সেনাবাহিনী যখনই উনাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন উনি কিন্তু সব অসুস্থতা সত্ত্বেও সেনাবাহিনীর ডাকে সাড়া দিয়েছেন। সেনাবাহিনী যথাযথ সম্মান দেখিয়ে উনার বাসা থেকে যেভাবে গার্ড দিয়ে নিয়ে এসেছে, জাতির অভিভাবক হিসেবে পুরো জাতি উনাকে সম্মান দেখিয়েছে। আমার মনে হয়, সেনাকুঞ্জের অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে তিনি যে বাংলাদেশের রাজনৈতিক আইকন সেটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে।’
Sharing is caring!