প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১২ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৯শে বৈশাখ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৪ই জিলকদ, ১৪৪৬ হিজরি

প্রকাশ্যে আসছে পুঁজিবাজারের রাঘববোয়ালদের নাম

editor
প্রকাশিত ডিসেম্বর ১৫, ২০২৪, ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ
প্রকাশ্যে আসছে পুঁজিবাজারের রাঘববোয়ালদের নাম

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

পুঁজিবাজার থেকে কারসাজির মাধ্যমে অর্থ লোপাটে জড়িতদের নাম একে একে সামনে আসছে। ২০১০ সালে পুঁজিবাজারে মহাধসের পর এর পেছনের ‘কারিগর’ হিসেবে সামনে আসে সালমান এফ রহমানের নাম। গত ১৫ বছরে পরিস্থিতির অনেক পরিবর্তন হয়েছে। কারসাজির পেছনে যুক্ত হয়েছেন আরও অনেকে। বাজার কারসাজির সঙ্গে জড়িতদের নামের তালিকা এখন বেশ বড়। আবুল খায়ের হিরু ও তার পরিবার, ক্রিকেটার সাকিব আল হাসান, সাংবাদিক এ এস এম হাসিব হাসানের নাম এখন ঘুরেফিরে আসছে। আর ছোটখাটো প্রায় অর্ধশত নাম এখন প্রকাশ্যে, যাদের বলা হচ্ছে পুঁজিবাজারের রাঘববোয়াল।

গণ-অভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর নতুন অন্তর্বর্তী সরকার সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন পুনর্গঠন করে। চেয়ারম্যানের দায়িত্বে আসেন সাবেক ব্যাংকার খন্দকার রাশেদ মাকসুদ। দায়িত্ব নেওয়ার পর এখন পর্যন্ত তিনি ১৫টি সভা করেছেন, যার প্রায় সবকটিতে কারসাজিকারীদের নাম প্রকাশ্যে এসেছে। তাদের ২৬১ কোটি টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

অন্যদিকে চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত কমিশনের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করেন শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। তার নেতৃত্বাধীন কমিশন চারটি সভা করে। সেগুলোতে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে নতুন শেয়ার ইস্যুর মাধ্যমে অর্থ উত্তোলন করার ক্ষমতা এবং বেশ কিছু বন্ড ছাড়ার সিদ্ধান্ত।

পুঁজিবাজার বিশ্লেষকরা বলছেন, গত ৫ আগস্টের পর নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর যাদের শেয়ার কারসাজির কারণে জরিমানা করা হয়েছে তারা সবাই আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন। এই তালিকায় এমন ব্যক্তিরা আছেন, যাদের বিরুদ্ধে আগে কেউ প্রশ্ন ওঠাতে সাহস পাননি।

পুঁজিবাজার বিশেষজ্ঞ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ও সরকারি প্রতিষ্ঠান ইনভেস্টমেন্ট করপোরেশন অব বাংলাদেশের (আইসিবি) চেয়ারম্যান আবু আহমেদ বলেন, ‘বিগত সরকারের সময়ে পুঁজিবাজারে কী হয়েছে, তা অর্থনীতি নিয়ে তৈরি করা শ্বেতপত্রেই উঠে এসেছে। এটাকে এক কথায় লুণ্ঠন বলতে হবে। আর এই রাঘববোয়ালদের সহযোগিতা করেছেন বিএসইসি, ডিএসইর সেই সময়কার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা।’

তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থেকে গত সাড়ে ১৫ বছর পুঁজিবাজারকে কমিশনের চেয়ারম্যানের মাধ্যমে আওয়ামীপন্থি ব্যবসায়ীদের হাতে তুলে দিয়েছিল। তাদের কোনো জবাবদিহি ছিল না, তারা আইনকানুনের তোয়াক্কা করেননি। আওয়ামী লীগ না হলে কেউ এখানে ব্যবসা করতে পারেননি। বিনিয়োগকারীদের সব ধরনের সুযোগ-সুবিধাকে ভূলুণ্ঠিত করছেন তারা।’

তিনি আরও বলেন, ‘কমিশন এখন একের পর এক যেভাবে পুঁজিবাজার কারসাজিকারীদের চিহ্নিত করে জরিমানা করছে, সেটি অব্যাহত রাখা উচিত এবং তাদের যথাযথ আইনের আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি।’

বাংলাদেশ পুঁজিবাজার বিনিয়োগকারী সম্মিলিত জাতীয় ঐক্যের সভাপতি আ ন ম আতাউল্লাহ নাঈম বলেন, ‘২০১০ সালে পুঁজিবাজার মহাধসের পর খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদের নেতৃত্বে একটি তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়। সেখানে আওয়ামী লীগ সরকারের আস্থাভাজন ব্যবসায়ীদের নাম উঠে আসে। ‘দরবেশ’খ্যাত সালমান এফ রহমান কখন কীভাবে পুঁজিবাজার থেকে হাজার কোটি টাকা চুরি করেন তার তথ্য ছিল। কিন্তু তখন তাদের কোনো শাস্তি হয়নি।’

তিনি আরও বলেন, ‘এখন তাদের শাস্তি হওয়া উচিত। তবে যতটুকু দেখা যাচ্ছে, সবই কাগজে-কলমে। এ অবস্থার উত্তরণ ঘটাতে হলে পুঁজিবাজার থেকে অর্থ লোপাটের অভিযোগে তাদের শাস্তির সম্মুখীন করতে হবে।’

পুঁজিবাজার নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিএসইসির নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, ‘কমিশন এখন আইন অনুযায়ী কারসাজিকারীদের খুঁজে বের করার কাজ শুরু করেছে। আগেও এ সুযোগ ছিল। কিন্তু আগের কমিশন কেন সেই কাজটি করেনি, সে ব্যাপারে মুখ খুলতে চাচ্ছি না।’

তিনি বলেন, ‘পুঁজিবাজারে কারসাজি করে যখন যারাই অর্থ লোপাট করেছেন, তাদের সবাইকে আইনের আওতায় আনা হবে।’

 

কারসাজিকারী, যারা এখন প্রকাশ্যে

আবুল খায়ের হিরু: শিবলী কমিশনের সময়ে ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসেন আবুল খায়ের। পুঁজিবাজারে তিনি হিরু নামে বেশ পরিচিত। ৩১তম বিএসএস (সমবায়) ক্যাডারের এই কর্মকর্তা বর্তমানে সমবায় অধিদপ্তরের উপনিবন্ধক হিসেবে কর্মরত। ৫ আগস্টের আগে পুঁজিবাজার কারসাজির সঙ্গে হিরুর নাম বারবার সামনে এলেও কার্যত ‘অজ্ঞাত কারণে’ কোনো উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। ২০২২ সালে শিবলী কমিশন তাকে শেয়ার কারসাজির কারণে ১৪ কোটি টাকা জরিমানা করে। তবে আদায় করতে পারেনি। বরং জরিমানা পরিশোধে রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে অবৈধভাবে সময় বাড়িয়ে নেন হিরু। গত ৫ আগস্টের পর নতুন কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর হিরু জরিমানা পরিশোধে আবারও এক বছরের সময় চান। তবে কমিশন তার আবেদন বাতিল করে মামলা করেছে। মোহাম্মদ রেজাউল করিম বলেন, হিরুর বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে চারটি মামলা করা হয়েছে।

হিরুর শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত ছিল তার পুরো পরিবার। তালিকায় আছেন তার বাবা আবুল কালাম মাতবর, স্ত্রী কাজী সাদিয়া হাসান, বোন কণিকা আফরোজ, ভাই সাজেদ মাতবর ও মোহাম্মদ বাসার, শ্যালক কাজী ফুয়াদ হাসান ও কাজী ফরিদ হাসান, নিকটাত্মীয় আলেয়া বেগম এবং হিরুর সুবিধাভোগী প্রতিষ্ঠান মোনাক হোল্ডিংস।

এরা সবাই ২০২১ সালে শেয়ার কারসাজির সঙ্গে জড়িত ছিলেন। নতুন কমিশন গত ৫ ডিসেম্বর সবাইকে একসঙ্গে ১৩৪ কোটি ৫৯ লাখ টাকা জরিমানা করে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি জরিমানা করা হয় হিরুর বাবাকে, ৩৩ কোটি ৬৬ লাখ টাকা। হিরুকে জরিমানা করা হয় ৩২ কোটি ৪৬ লাখ টাকা।

 

সাকিব আল হাসান: বিশ্বসেরা ক্রিকেট অলরাউন্ডার হিসেবে সারা বিশ্বে সুনাম অর্জন করতে পারলেও পুঁজিবাজারের খেলায় মারাত্মকভাবে হেরে গেছেন সাকিব আল হাসান। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মাগুরা-১ আসন থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে তিনি সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ৫ আগস্টের পর পুঁজিবাজারে তার কারসাজির ফিরিস্তি উঠে আসে। একের পর এক জরিমানা করা হয় তাকে।

কমিশন পুনর্গঠনের পর প্রথম সভায় সাকিবকে শুভেচ্ছাদূত বা অ্যাম্বাসেডর পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। আগের কমিশন তাকে সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশনের বিনিয়োগ শিক্ষা কর্মসূচির শুভেচ্ছাদূত মনোনীত করেছিল।

প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির শেয়ার লেনদেনে কারসাজি করে সাকিব আল হাসান প্রায় ৯০ লাখ টাকা মুনাফা করেন। পুঁজিবাজারে মাত্র তিন দিনের এই ‘খেলায়’ সাকিব বিনিয়োগ করেন ৭ কোটি টাকা। পুঁজিবাজারে মুনাফা করার জন্যই বিনিয়োগ, তাহলে এমন মুনাফা কেন অবৈধ? এমন প্রশ্নের উত্তরে বিএসইসি নির্বাহী পরিচালক রেজাউল করিম বলেন, বিনিয়োগ করার মাত্র পাঁচ দিনের মাথায় এমন মুনাফা অস্বাভাবিক এবং তিনি তা উত্তোলন করেছেন। এর ফলে পুঁজিবাজারের সাধারণ বিনিয়োগকারীরা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। এ জন্যই তাকে জরিমানা করা হয়েছে।

সাংবাদিক এ এস এম হাসিব হাসান: আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ কমিশনের চেয়ারম্যান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম বছরজুড়ে আলোচনায় ছিলেন দুর্বল কোম্পানির বোর্ড পুনর্গঠন নিয়ে। এই সুযোগে সামনে আসেন সাংবাদিক এ এস এম হাসিব হাসান। সাবেক চেয়ারম্যানের আস্থাভাজন হয়ে তিনি তালিকাভুক্ত কোম্পানি হামি ইন্ডাস্ট্রিজের ব্যবস্থাপনা পরিচালকের পদে বসেন। আগে এই প্রতিষ্ঠান ইমাম বাটন নামে বহুল পরিচিত ছিল। পদে বসেই তিনি বছরের মধ্যে বিভিন্ন সময়ে জুতার ফ্যাক্টরি আর মাছ চাষের মিথ্যা তথ্য ছড়িয়ে পুঁজিবাজার থেকে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তবে সব জানা থাকা সত্ত্বেও সে সময় শিবলীর নিয়ন্ত্রণাধীন কমিশন হাসিবের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এমন কারসাজির দায়ে চলতি কমিশন ১৮ সেপ্টেম্বর হাসিবকে ১ কোটি টাকা জরিমানা করে। ২২ সেপ্টেম্বর তিনি আকস্মিকভাবে মারা যান। অবশ্য তার মৃত্যু নিয়ে রহস্য রয়েছে।

 

বেক্সিমকো গ্রুপ: বিএসইসির সর্বশেষ কমিশন সভায় বেক্সিমকো গ্রুপের মালিকানাধীন তিনটি প্রতিষ্ঠান- বেক্সিমকো লিমিটেড, বেক্সিমকো ফার্মাসিউটিক্যালস ও শাইনপুকুর সিরামিকসের গত পাঁচ বছরের আর্থিক কর্মকাণ্ড বিশেষ নিরীক্ষা করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

বেক্সিমকো গ্রুপের ভাইস চেয়ারম্যান সালমান এফ রহমান এখন জেলে আছেন। তিনি দীর্ঘদিন সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বেসরকারি খাত উন্নয়ন উপদেষ্টার দায়িত্বে ছিলেন।

শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম: ২০২৪ সালের মে মাসে চার বছরের জন্য কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে পুনর্নিয়োগ পান শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলাম। এর আগে ২০২০ সালের ১৭ মে তাকে প্রথমবার বিএসইসির চেয়ারম্যান নিযুক্ত করা হয়। তার বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় অভিযোগ ছিল, তিনি পুঁজিবাজারের দুর্বল কোম্পানিগুলোর বোর্ড পুনর্গঠন করে বাজার কারসাজিকারীদের হাতে তুলে দিয়েছেন। তার সময়কালে মোট ২৫টির বেশি কোম্পানির বোর্ড পুনর্গঠন করা হলেও একটি কোম্পানিও সচল হয়নি।

৫ আগস্টে ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে শেখ হাসিনার নেতৃত্ব বদল হওয়ার পাঁচ দিনের মধ্যে ১০ আগস্ট তিনি পদত্যাগ করেন। পুঁজিবাজারে দুর্বল কোম্পানি তালিকাভুক্তসহ সাবেক সরকারের আস্থাভাজনদের অবৈধ সুযোগ-সুবিধা দেওয়ায় গত ২০ আগস্ট তার ও তার ছেলে জুহায়ের সারার ইসলামের ব্যাংক হিসাব জব্দ করা হয়।

একাধিকবার শিবলী রুবাইয়াত-উল ইসলামকে ফোনে যোগাযোগ করার চেষ্টা করা হলেও তিনি সাড়া দেননি।

সোনালী পেপার: পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত কোম্পানি সোনালী পেপার অ্যান্ড বোর্ড মিলস লিমিটেডের শেয়ার লেনদেনে কারসাজি করে সিকিউরিটিজ আইন ভঙ্গের অভিযোগে সোনালী পেপার কোম্পানির তিন ব্যক্তিকে ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয় গত ৬ ডিসেম্বর। প্যারামাউন্ট ইন্স্যুরেন্স কোম্পানি লিমিটেডের শেয়ার লেনদেনে কারসাজির দায়ে কোম্পানিটির ব্যবস্থাপনা পরিচালকসহ পরিচালনা পর্ষদের প্রত্যেক পরিচালককে ২০ লাখ টাকা করে মোট ৬০ লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে।

Sharing is caring!