
প্রজন্ম ডেস্ক:
বাংলাদেশ রেলওয়ের ২৯টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এসব প্রকল্পে এ পর্যন্ত ১ লাখ ২৪ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা খরচ হয়েছে। এর মধ্যে চারটি বড় প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষের পথে। এ চার প্রকল্পে ইতিমধ্যে ৬০ হাজার কোটি টাকা ব্যয়ও করা হয়ে গেছে। এই বিশাল অঙ্কের অর্থ খরচের পরও প্রকল্পগুলো স্থবির হয়ে আছে। দেশের মানুষ এর কোনো সুফল এখনও পাচ্ছে না।
এ ছাড়া প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও জনবল নিয়োগ না দেওয়ায় সংকট আরও বেড়েছে। রেলের বিভিন্ন সরঞ্জাম চুরি হয়ে যাচ্ছে, স্থাপনাগুলো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ও রেলের জায়গা বেদখল হয়ে যাচ্ছে। পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি) ও অডিট অধিদফতরের প্রতিবেদনে এসব চিত্র উঠে এসেছে।
দেশের মানুষের যাতায়াতে ভোগান্তি কমানো এবং অর্থনীতি সচল রাখতে যোগাযোগ খাতকে প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। এর ধারাবাহিকতায় সড়কের পাশাপাশি রেলের উন্নয়নে বরাদ্দসহ বিভিন্ন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়। তবে রেলের বেশকিছু প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও জলবল সংকটে চালুই হয়নি বিভিন্ন স্টেশন। এতে করে থমছে গেছে উন্নয়ন কার্যক্রম।
অন্যদিকে উন্নয়নকাজ শেষ হলেও ব্যবহার না হওয়ায় স্টেশন ভবনের গ্রিল, দরজা, সিগন্যালিং ব্যবস্থা ও অন্যান্য মালামাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। স্টেশনের স্টাফ কোয়ার্টারগুলো আগাছায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে, নষ্ট হচ্ছে ভবনগুলোর জানালা, দরজা ও অন্যান্য অবকাঠামো। সে সঙ্গে রেলের জায়গা দখল করে তৈরি করা হয়েছে অবৈধ স্থাপনা। এ ছাড়া স্টেশন নির্মাণের অনেক যন্ত্রপাতিও চুরি হয়ে যাচ্ছে। রেলওয়ের দাবি, লোকবলের অভাবে এসব স্টেশন চালু করা যাচ্ছে না।
আইএমইডি সূত্রে জানা গেছে, বাংলাদেশ রেলওয়ের ২৯টি প্রকল্প চলমান রয়েছে। এসব প্রকল্পের মধ্যে দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্প এবং পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের (২য় সংশোধিত) প্রকল্পের কাজ প্রায় শেষ। এ ছাড়া লাকসাম-চিনকি আস্তানার মধ্যে ডাবল লাইন ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প এবং কাশিয়ানী- গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া নতুন রেলপথ প্রকল্পের কাজও ৫ বছর আগে শেষ হয়েছে। শুধু লোকবল সংকটে এসব প্রকল্পে অপারেশনাল কাজ শুরুই করতে পারেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। অথচ এসব প্রকল্পে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত মোট খরচ হয়েছে ৬০ হাজার ৫০৩ কোটি ৩৮ লাখ টাকা।
প্রকল্প সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উন্নয়নের এসব প্রকল্পের কাজ থমকে গেছে শুধু লোকবলের অভাবে। ফলে এসব প্রকল্প থেকে তেমন ফিডব্যাকও পাচ্ছে না সরকার।
আইএমইডির প্রতিবেদনে জানানো হয়, দোহাজারি-কক্সবাজার রেললাইন প্রকল্পের (প্রথম সংশোধিত) চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত কাজের ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯৮ দশমিক ৮০ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৫১ দশমিক ৪৪ শতাংশ। টাকার অঙ্কে মোট খরচ হয়েছে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৮ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকার যোগান দিয়েছে ৪ হাজার ৯১৯ কোটি ৭ লাখ টাকা। প্রকল্পে ঋণের অর্থ খরচ হয়েছে ১৩ হাজার ১১৫ কোটি ৪১ লাখ টাকা।
বিপুল অর্থ ব্যয়ে নির্মাণের পরও আলোচিত এই প্রকল্পের স্টেশন নির্মাণ স্থাপনায় ফাটল দেখা দেওয়ার পাশাপাশি কয়েকটি স্টেশনের গ্রিলে এরই মধ্যে আগাছা জন্মেছে। বসতি নেই-এমন এলাকায়ও স্টেশন বানানো হয়েছে, অথচ সেখানে যাতায়াতের জন্য নির্মাণ করা হয়নি কোনো সংযোগ সড়কও। তাই গরু-ছাগল ও স্থানীয়দের আড্ডার জায়গায় পরিণত হয়েছে স্টেশনগুলো। কোটি টাকার গাছপালাও মরে যাচ্ছে পরিচর্যার অভাবে। বরাদ্দের অর্থ খরচ হয়ে গেলেও অনেক জায়গাতেই গাছ লাগানোর কোনো চিহ্নও দেখা যায়নি বলে অডিট প্রতিবেদনে জানানো হয়। শুধু জনবলের অভাবে এসব প্রকল্পের কাজে স্থবিরতা দেখা দিয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।
অন্যদিকে পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের (২য় সংশোধিত) এ পর্যন্ত ভৌত অগ্রগতি হয়েছে ৯৬ দশমিক ৮৫ শতাংশ। আর্থিক অগ্রগতি হয়েছে ৮৮ দশমিক ৬১ শতাংশ। তার মধ্যে ঢাকা-মাওয়া অংশে কাজের অগ্রগতি দাঁড়িয়েছে ৯৮ শতাংশ। মাওয়া-ভাঙ্গায় ৯৯ দশমিক ৬০ শতাংশ ও ভাঙ্গা-যশোর অংশে কাজ হয়েছে ৯৮ শতাংশ।
এই প্রকল্পে চলতি বছরের নভেম্বর পর্যন্ত মোট খরচ হয়েছে ৩৮ হাজার ৬২৪ কোটি ৯০ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারের খরচ হয়েছে ১৭ হাজার ৬৬৮ কোটি ৮০ লাখ টাকা। প্রকল্প ঋণে খরচ হয়েছে ২০ হাজার ৯৫৬ কোটি ১০ লাখ টাকা।
এই প্রকল্পে ভাঙ্গা জংশনে রেললাইনের বিভিন্ন যন্ত্রপাতি বা ফিটিংস চুরি হয়ে যাচ্ছে। এসব চুরিরোধে প্রকল্পে জনবল নিয়োগ করা প্রয়োজন বলে অডিট প্রতিবেদনে জানানো হয়।
এ ছাড়া আইএমইডির দুটি সমাপ্ত প্রকল্পের প্রভাব মূলায়ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লাকসাম-চিনকি আস্তানার মধ্যে ডাবল লাইন ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্প এবং কাশিয়ানী-গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া নতুন রেলপথ প্রকল্পের আওতায় আটটি স্টেশন নির্মাণ করা হয়েছে। যা এখনও লোকবলের অভাবে চালুই করতে পারেনি রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ। এ দুই প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৩ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা।
চালু না হওয়া ৮টি স্টেশনের মধ্যে ৪টি স্টেশন জাপানের অর্থায়নে লাকসাম-চিনকি আস্তানার মধ্যে ডাবল লাইন ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পের আওতায় নির্মাণ করা হয়। স্টেশনগুলো হলো-কুমিল্লার লাকসাম উপজেলার নওটি, একই জেলার নাঙ্গলকোটের শার্শাদি, ফেনীর জেলার কালীদহ ও মহুরীগঞ্জ। এই প্রকল্পের আওতায় মোট ১১টি স্টেশন নির্মাণ করা হয়। বাস্তবায়ন কাজ শেষ হয় ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে।
বন্ধ থাকা বাকি ৪টি স্টেশন নির্মাণ করা হয় কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া সেকশন পুনবার্সন এবং কাশিয়ানী-গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া নতুন রেলপথ প্রকল্পের আওতায়। স্টেশন হলো-গোপালগঞ্জ জেলার টুঙ্গিপাড়ার বোড়াশী, চন্দ্রদিঘলিয়া, কাশিয়ানীর ছোট-বাহিরবাগ এবং চাপতা। এই প্রকল্পের আওতায় মোট ১৯টি স্টেশন নির্মাণ করা হয়। এই প্রকল্পের কাজও শেষ হয়েছে ২০১৮ সালে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, নির্মাণের পর থেকে চালু না হওয়ায় দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত হয়ে পড়ে আছে স্টেশনগুলো। ফলে স্টেশন ভবনগুলোতে স্থাপিত গ্রিল, দরজা ও অন্য মালামাল নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এমনকি স্টেশনগুলোর সিগন্যালিং সিস্টেমও অকেজো হয়ে পড়ে আছে। গোবরা, বোড়াশী, চন্দ্রদিঘলিয়া, ছোট বাহিরবাগ এবং চাপতাÑমোট ৫টি স্টেশনের প্রতিটিতে তিনটি করে স্টাফ কোয়ার্টার নির্মাণ করা হলেও ব্যবহার হচ্ছে না। ফলে স্টাফ কোয়ার্টারগুলো আগাছায় পরিপূর্ণ হয়ে আছে। ভবনগুলোর দরজা, জানালা ও অন্যান্য অবকাঠামো নষ্ট হয়ে যাচ্ছে ।
প্রতিবেদনে পর্যালোচনায় দেখা গেছে, দীর্ঘদিন অব্যবহৃত থাকার ফলে নষ্ট হচ্ছে স্টেশনগুলোর ভবনসহ বিভিন্ন যন্ত্রাংশ, চুরি হয়ে গেছে রেল ক্লিপ, ভেঙে গেছে সিøপার। অকেজো হয়ে পড়ে আছে সিগন্যালিং সিস্টেম, প্রকল্প এলাকায় রেলের জায়গা দখল করে অবৈধ স্থাপনা তৈরি করা হয়েছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, স্টেশনগুলোতে প্রয়োজনীয় সব অবকাঠামো থাকা সত্ত্বেও জনবল না থাকায় যথাযথভাবে ব্যবহৃত হচ্ছে না। ফলে এসব স্টেশন কাউন্টার থেকে কোনো টিকেট বিক্রি হয় না। যাত্রীরা ট্রেনে উঠে টিটির কাছ থেকে টিকেট সংগ্রহ করে থাকে।
আইএমইডির প্রতিবেদন বলছে, লাকসাম-চিনকি আস্তানার মধ্যে ডাবল ট্র্যাক নির্মাণ প্রকল্পটির বাস্তবায়ন কাজ শুরু হয় ২০০৮ সালের জুনে। ৫ বছরে শেষ হওয়ার কথা থাকলেও ১০ বছরের বেশি লেগেছে কাজ শেষ করতে। এই প্রকল্পে ব্যয় শুরুতে ছিল ৫০১ কোটি টাকা। পরে দুইবার ব্যয় বাড়ানো হয়। শেষ পর্যন্ত প্রকল্পটি বাস্তবায়নে প্রয়োজন হয়েছে ১ হাজার ৮০৯ কোটি টাকা।
অন্যদিকে কালুখালী-ভাটিয়াপাড়া সেকশন পুনবার্সন এবং কাশিয়ানী গোপালগঞ্জ-টুঙ্গিপাড়া নতুন রেলপথ নির্মাণের কাজ শুরু হয় ২০১০ সালের অক্টোবরে। এই প্রকল্পটিও শেষ হওয়ার কথা ছিল ২০১৩ সালের জুনে। কিন্তু কাজ শেষ হয়েছে ২০১৮ সালের ডিসেম্বরে। শুরুতে প্রকল্পটির ব্যয় ধরা হয়েছিল ১ হাজার ১০১ কোটি টাকা। শেষপর্যন্ত এই প্রকল্পে প্রয়োজন হয়েছে ২ হাজার ৩৫ কোটি টাকা।
আলোচ্য দুই প্রকল্পের বন্ধ স্টেশনগুলোর বিষয়ে আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, অবস্থা দেখে মনে হয়েছে এগুলো কোনো পরিকল্পনা ছাড়াই করা হয়েছে। ওই ভবনগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় আছে, যা অনাকাক্সিক্ষত ও অনভিপ্রেত। সরকারি অর্থে নির্মিত এসব অবকাঠামোর যথাযথ ব্যবহারের বিষয়ে বাংলাদেশ রেলওয়ে ও রেলপথ মন্ত্রণালয়কে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে আইএমইডি।
রেলের প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে, পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পের (২য় সংশোধিত) ইতিমধ্যে প্রকল্পের আরডিপিপির সংস্থান অনুযায়ী রাজস্ব খাতে নতুন ১ হাজার ৬৮০টি পদ সৃজনের প্রস্তাব রেলমন্ত্রণালয় থেকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে অর্থমন্ত্রণালয়ে এর কার্যক্রম প্রক্রিয়াধীন।
বাংলাদেশ রেলওয়ের অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অবকাঠামো) আল ফাত্তাহ মো. মাসউদুর রহমান বলেন, বর্তমানে রেলওয়েতে ৪৭ হাজারের অধিক লোকবল রয়েছে। এর মধ্যে ২৪ হাজারের বেশি লোক নতুন রেলের প্রকল্পের কাজে নিয়োজিত করা হবে।
তিনি বলেন, বর্তমানে রেলওয়ের অপারেশনাল লোকদের বেশি গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। যেসব প্রকল্পের কাজ শেষ- সেসব জায়গা থেকে সদ্য সমাপ্ত প্রকল্পে রিক্রুটমেন্ট করার নির্দেশনা রয়েছে। এ ছাড়া রেলে জনবল নিয়োগের জন্য জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে কাগজ পাঠানো হয়েছে।
পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অধীন বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগের (আইএমইডি) সচিব আবুল কাশেম মো. মহিউদ্দিন বলেন, লোকবল সংকট অনেক বড় সমসা। এই সমস্যার সমাধানের জন্য আমরা একটা সিদ্ধান্তে এসেছিলাম। প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যাতে লোকবল নিযোগ করা হয়, সে জন্য আগে পদ সৃজনের কথা বলা হয়েছিল।
Sharing is caring!