
প্রজন্ম ডেস্ক:
প্রধান উপদেষ্টার নির্দেশনা অনুসরণ করলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিনক্ষণ প্রশ্নে দুই ধরনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রথমত নির্বাচন এ বছরের ডিসেম্বর বা ২০২৬-এর জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত হলে আগামী ২ মার্চ প্রকাশিতব্য ভোটার তালিকা অনুযায়ী হবে। আরও পিছিয়ে নির্বাচন আগামী ২০২৬-এর মধ্যভাগে চলে গেলে সে ক্ষেত্রে পরবর্তী হালনাগাদ ভোটার তালিকা অনুযায়ী অনুষ্ঠিত হবে।
ইসির নির্ভরযোগ্য সূত্রগুলো থেকে জানা গেছে, এই দুই ধরনের ভোটার তালিকা বিবেচনায় রেখেই নির্বাচনের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নিচ্ছে বর্তমান কমিশন। এ ছাড়া সংসদ নির্বাচন ছাড়া স্থানীয় সরকারগুলোর নির্বাচনের ক্ষেত্রেও দুই ধরনের প্রস্তুতি রেখে এগোচ্ছে কমিশন।
আজ সোমবার থেকে পুনরায় ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম উদ্বোধন করতে যাচ্ছে ইসি। সকাল সাড়ে ১০টায় ঢাকা জেলার সাভার উপজেলা পরিষদ মিলনায়তনে প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও চার নির্বাচন কমিশনারসহ ইসির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত থেকে এই কর্মসূচির উদ্বোধন করবেন।
ইসির নির্বাচন প্রস্তুতির প্রথম ধাপ হলো ভোটার তালিকা চূড়ান্তকরণ। এই কাজ ইতোমধ্যে পুরোদমে শুরু করেছে সংস্থাটি। এরই মধ্যে গত ২ জানুয়ারি চলতি বছরের খসড়া ভোটার তালিকা প্রকাশ করা হয়েছে। তাতে যুক্ত হয়েছে ১৮ লাখ ৩৩ হাজার ৩৫২ নতুন ভোটার। সব মিলিয়ে মোট ভোটার সংখ্যা ১২ কোটি ৩৬ লাখ ৮৩ হাজার ৫১২। ২০২৫ সালের ১ জানুয়ারি যারা ভোটার হওয়ার যোগ্য হয়েছেন, ওই তালিকায় তাদের যুক্ত করা হয়েছে।
গত বছরের ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস উপলক্ষে জাতির উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, ২০২৫ সালের শেষ দিকে অথবা ২০২৬ সালের প্রথম দিকে বা মাঝামাঝিতে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আয়োজন করতে পারবেন। প্রধান উপদেষ্টা ওই সময় বলেন, ‘প্রধান সংস্কারগুলো সম্পন্ন করে নির্বাচন আয়োজন করার ব্যাপারে বারবার আপনাদের কাছে আবেদন জানিয়ে এসেছি। তবে রাজনৈতিক ঐকমত্যের কারণে আমাদের যদি অল্প কিছু সংস্কার করে ভোটার তালিকা নির্ভুলভাবে তৈরি করার ভিত্তিতে নির্বাচন সম্পন্ন করতে হয়, তাহলে ২০২৫ সালের শেষের দিকে নির্বাচন অনুষ্ঠান হয়তো সম্ভব হবে। আর যদি এর সঙ্গে নির্বাচন প্রক্রিয়া এবং নির্বাচন সংস্কার কমিশনের সুপারিশের পরিপ্রেক্ষিতে এবং জাতীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে প্রত্যাশিত মাত্রার সংস্কার করি তাহলে অন্তত আরও ছয় মাস অতিরিক্ত সময় লাগতে পারে।
তিনি বলেছেন, ‘২০২৬ সালের প্রথমার্ধ অথবা মাঝামাঝি সময়ে ভোট আয়োজন করা সম্ভব হবে।’ এ ছাড়া গত ৮ জানুয়ারি ইইউ ইনভেস্টমেন্ট ব্যাংকের ভাইস প্রেসিডেন্ট নিকোলা বিয়ারের সঙ্গে সাক্ষাতে প্রধান উপদেষ্টা জানান, একই সঙ্গে জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি নিয়ে এগোচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর মতামত নিয়ে সরকার যদি জাতীয় নির্বাচনের আগেই স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজনে ইসিকে নির্দেশ দেয়, সে ক্ষেত্রে এবারের চূড়ান্ত ভোটার তালিকা অনুযায়ী সেই ভোট করা সম্ভব হবে।
রাষ্ট্রকাঠামো বিনির্মাণে বিভিন্ন সংস্কার প্রস্তাব বাস্তবায়নের আগে নাকি পরে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে, এ নিয়ে রাজৈনৈতিক দলগুলোর মধ্যে নানা আলোচনা ও বিতর্কের মধ্যে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এ এম এম নাসির উদ্দিন বলেছেন, ‘নির্বাচন কমিশন কোনো রাজনৈতিক দলের পক্ষ নিচ্ছে না এবং সংবিধানের আওতার মধ্যে থেকেই কাজ করছে।’ তিনি বলেন, ‘সরকারের নির্ধারিত সময়সীমা অনুযায়ী আমরা নির্বাচন আয়োজনের সব ধরনের প্রস্তুতি নিচ্ছি। ফ্রি, ফেয়ার গেম উপহার দিতে আমরা আইনকানুন ও বিধিবিধানের মধ্যে থাকতে চাই। দেশের মানুষ আমাদের কাছ থেকে একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন আশা করে।’
গতকাল রবিবার সকালে নির্বাচন কমিশন ভবনে ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রমে ইসিকে জাতিসংঘের উন্নয়ন কর্মসূচির (ইউএনডিপি) পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় ল্যাপটপ, স্ক্যানারসহ অন্যান্য সরঞ্জাম হস্তান্তর অনুষ্ঠানে তিনি বলেন, ‘আমরা সেই প্রত্যাশা পূরণে অঙ্গীকারবদ্ধ। মানুষের যে সন্দেহ রয়েছে, তা দূর করতে ভোটার তালিকা হালনাগাদ প্রক্রিয়াকে স্বচ্ছতার সঙ্গে সম্পন্ন করা হবে।’
বর্তমান সিইসি নাসির উদ্দিন নেতৃত্বাধীন কমিশনও দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বলে আসছে সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা জাতীয় নির্বাচন ও স্থানীয় সরকার নির্বাচনের প্রস্তুতি একসঙ্গে নিচ্ছে। এদিকে গত ১৫ জানুয়ারি নির্বাচনব্যবস্থাকে স্বচ্ছ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করার লক্ষ্যে সরকারের কাছে প্রায় ১৫০ ধরনের সুপারিশ করেছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। ফলে আগে সংস্কার, না আগে নির্বাচন? কোন নির্বাচন আগে হবে- জাতীয় না স্থানীয় সরকার নির্বাচন? এসব বিষয় নিয়ে রাজনৈতিক দল ও জনসাধারণের মধ্যে ভিন্নমত দেখা গেছে। বিএনপি ন্যুনতম সংস্কারের পর দ্রুততম সময়ের মধ্যে নির্বাচন চাইছে।
অন্যদিকে জামায়াতে ইসলামীসহ কিছু দল প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে নির্বাচনের পক্ষে। ফলে সরকাকে এই দুই মতামতের মধ্যে ভারসাম্য রক্ষা করে অগ্রসর হতে হচ্ছে।
এ বিষয়ে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান ড. বদিউল আলম মজুমদার জানিয়েছেন, তার কমিশনের জরিপে বেশির ভাগ তৃণমূল নেতা ও জনতা জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় নির্বাচনের পক্ষে মত দিয়েছেন। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সুপারিশ প্রসঙ্গে সিইসি জানিয়েছেন, ইসিকে শক্তিশালী করতে যতগুলো সুপারিশ থাকবে, সবগুলোর পক্ষে তাদের অবস্থান।
গত ১২ জানুয়ারি ইসির ১৪তম কমিশনের দ্বিতীয় সভা শেষে নির্বাচন কমিশনার ব্রিগেডিয়ার (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ জানান, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না নাসির উদ্দিন কমিশন। কারণ আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে জাতীয় নির্বাচন ব্যাহত হওয়ার আশঙ্কা করছে সংস্থাটি। এমন পরিস্থিতিতে ইসির সামগ্রিক মনোযোগ (ফোকাস) স্থানীয় সরকার নির্বাচন নয়, বরং জাতীয় নির্বাচনের দিকে। আর বর্তমান কমিশন জাতীয় নির্বাচনেরই প্রস্তুতি নিচ্ছে। ইসির নির্বাচন প্রস্তুতি পর্যবেক্ষণে দেখা যাচ্ছে, জাতীয় নির্বাচনের জন্য সরকারের দুটি সম্ভাব্য সময়সীমা (আগামী ডিসেম্বর অথবা ২০২৬ সালের মাঝামাঝি) ধরেই জাতীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে বর্তমান কমিশন। পাশাপাশি দলীয় ঐকমত্যের ভিত্তিতে সরকার চাইলে স্থানীয় সরকার নির্বাচন আয়োজন করতে তাদের কোনো অসুবিধা হবে না।
ভোটার তালিকা হালনাগাদ কার্যক্রম প্রসঙ্গে জানা গেছে, টানা দুই সপ্তাহ (৩ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত) চলবে বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদের কাজ। নিবন্ধন কেন্দ্রেই নাগরিকদের বায়োমেট্রিক গ্রহণের কাজ সম্পন্ন করা হবে ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ১১ এপ্রিল পর্যন্ত। উপজেলা/থানা নির্বাচন কর্মকর্তার কার্যালয়ে ভোটার এলাকা স্থানান্তরের আবেদন গ্রহণ, মৃত ভোটারদের নাম কর্তনের তথ্যাদি এবং নতুন ভোটারের তথ্য সফটওয়্যারের সাহায্যে ডেটা এন্ট্রি ও আপলোড করা হবে ১২ ফেব্রুয়ারি থেকে ১৬ এপ্রিল পর্যন্ত। নতুন করে ভোটার তালিকা আইন সংশোধন করা না হলে, এসব নতুন ভোটারের তথ্য আগামী ২০২৬ সালের ২ জানুয়ারি তালিকায় যুক্ত হবে। এরপর দাবি-আপত্তি নিষ্পত্তি শেষে ইসির চূড়ান্ত ভোটার তালিকা প্রকাশ হবে আগামী বছরের ২ মার্চ।
ইসির তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭-০৮ সালে ছবিযুক্ত ভোটার তালিকা প্রণয়নের পর এ পর্যন্ত বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে ছয়বার। ২০০৯-১০, ২০১২-১৩, ২০১৫-১৬, ২০১৭-১৮, ২০১৯-২০ ও ২০২২-২৩ সাল পর্যন্ত। বাড়ি বাড়ি গিয়ে এবারের ভোটার তালিকা হালনাগাদ কাজে ১০ কোটি টাকা ব্যয়ে সংশ্লিষ্ট নির্বাচন কর্মকর্তা, সুপারভাইজার ও তথ্য সংগ্রহকারী ৬৬ হাজার নির্বাচন কর্মকর্তাকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে নির্বাচন কমিশন।
Sharing is caring!