প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২২শে জুন, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৮ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
২৬শে জিলহজ, ১৪৪৬ হিজরি

নেতৃত্বের দুর্বলতায় প্রশাসনে কাটছে না ধীরগতি

editor
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ৮, ২০২৫, ১২:১৩ অপরাহ্ণ
নেতৃত্বের দুর্বলতায় প্রশাসনে কাটছে না ধীরগতি

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছয় মাস পূর্ণ হচ্ছে আজ। কিন্তু প্রশাসনে এখনও আসেনি কাঙ্ক্ষিত গতি। দায়িত্ব নেওয়ার পর চরম বিশৃঙ্খল অবস্থা কাটিয়ে উঠতে পারলেও গণঅভ্যুত্থানের পর জনপ্রত্যাশা অনুযায়ী প্রশাসন এগোচ্ছে না বলে মনে করেন জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা ও সাবেক আমলারা।

তারা বলছেন, নেতৃত্বের দুর্বলতার কারণে গত ছয় মাসেও জনপ্রশাসনে গতিশীলতা আসেনি। এখনও দৃষ্টিগ্রাহ্য কোনো সংস্কারও আনা হয়নি প্রশাসনে। বরং প্রশাসনের ধীরগতির কারণে সরকারের অগ্রাধিকার বা গুরুত্বপূর্ণ কাজগুলো বাস্তবায়নে বিলম্ব হচ্ছে।

 

আর অনভিজ্ঞতার আরেকটি বড় নির্দশন হলো শুরু থেকেই প্রশাসনে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্ত বাদলাতে হচ্ছে। এটি নেতিবাচক ধারণা তৈরি করছে। এমনকি এখন পর্যন্ত ১০টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের পদ খালি রয়েছে।

বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে আওয়ামী লীগ সরকারের সুবিধাভোগী বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে ওএসডি করা হয়েছে। কাউকে পাঠানো হয়েছে বাধ্যতামূলক অবসরে। উল্টোদিকে বঞ্চনার শিকার বিপুল সংখ্যক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। পদোন্নতি-পদায়নের ক্ষেত্রেও দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেননি প্রশাসনের নেতৃত্ব দেওয়া কর্মকর্তারা। ঢালাও পদোন্নতির সুযোগে আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগী দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তাদের লাভবান হওয়ার অভিযোগ আছে।

 

সরকারি কর্মচারীদের সম্পদের হিসাব নিতে উদ্যোগ নেওয়া হলেও দফায় দফায় সময় বাড়িয়ে খুব বেশি সাড়া মেলেনি বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় থেকে জানা গেছে।

ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। ওইদিনই বিলুপ্ত হয় মন্ত্রিসভা। পরদিন ৬ আগস্ট দ্বাদশ জাতীয় সংসদ ভেঙে দেন রাষ্ট্রপতি। এরপর গত ৮ আগস্ট শপথ নেয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। এ সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব নেন শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ওই সময় নিয়োগ পান ১৬ জন উপদেষ্টা। ঢাকা ও দেশের বাইরে থাকায় তিনজন উপদেষ্টা ওইদিন শপথ নিতে পারেননি। তারা পরে শপথ নেন। সর্বশেষ ১০ নভেম্বর তিনজন উপদেষ্টা ও প্রতিমন্ত্রীর পদমর্যাদায় তিনজন বিশেষ সহকারী যুক্ত হন অন্তর্বর্তী সরকারে।

 

 

অন্যদিকে, ২০ ডিসেম্বর বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন এবং ভূমি উপদেষ্টা এ এফ হাসান আরিফ মারা যান। এখন এ সরকারে প্রধান উপদেষ্টাসহ মোট উপদেষ্টা রয়েছেন ২৩ জন।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় নিজের কাছে রেখেছেন প্রধান উপদেষ্টা। এছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ, প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, সশস্ত্র বাহিনী বিভাগ, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রণালয় প্রধান উপদেষ্টার অধীনে রয়েছে। সাতজন ছাড়া বাকি উপদেষ্টারা একাধিক মন্ত্রণালয় ও বিভাগ সামলাচ্ছেন। উপদেষ্টা মাহফুজ আলমের কোনো দপ্তর নেই।

অন্তর্বর্তী সরকারের ছয় মাসের মূল্যায়ন প্রসঙ্গে জানতে চাইলে সাবেক সচিব আবু আলম মো. শহীদ খান বলেন, ‘গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের ছয় মাস হলো। এরমধ্যে প্রশাসন, পুলিশ ও বিচার বিভাগে যে সংস্কার এবং যে ধরনের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রয়োজন ছিল, সেটা মনে হয় মানুষ দেখতে পাচ্ছে না। সরকারে যারা দায়িত্বে আছেন, তারা যেভাবে নেতৃত্ব দেবেন, যেভাবে সরকারি কর্মচারীদের সুরক্ষা দিয়ে কাজে নামিয়ে দেবেন, সরকারের কাজকে গতিশীল করবেন-সেটা দেখা যাচ্ছে না। তাই এই জায়গায় তাদের আরও মনোযোগী হওয়ার প্রয়োজন আছে।’

 

তিনি বলেন, ‘প্রশাসনে অনেক সিদ্ধান্তহীনতা দেখছি যেটা মানুষকে হতাশ করে। বারবার সিদ্ধান্ত নিয়ে সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করলে তো প্রশাসনকে ওই জায়গায় নিয়ে যাওয়া যাবে না, যেই জায়গায় নিয়ে যাওয়ার দরকার একটা উৎসবমুখর, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য। সেটার জন্যই তো আমাদের এ পরিবর্তনগুলো দরকার।’

 

‘যে নির্বাচনের জন্য জাতি উন্মুখ হয়ে আছে, সিদ্ধান্তহীনতা ও নেতৃত্বের দুর্বলতা সেই নির্বাচন হওয়া না হওয়ার বিষয়টিকে আরও বেশি শঙ্কায় ফেলে দিচ্ছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের মধ্যে অনৈক্য দেখা যাচ্ছে, এটার ফলে সরকারের ওপর আস্থা ও বিশ্বাসের চিড় ধরছে।’

 

আবু আলম মো. শহীদ খান আরও বলেন, ‘আগামী দিনে সরকারের মূল ফোকাস হবে নেতৃত্ব দেওয়া। উপদেষ্টারা হলেন মন্ত্রণালয়ের প্রধান নির্বাহী, তাদের দায়িত্বটা ঠিকমতো বুঝে নিয়ে গণকর্মচারীদের পরিচালনা করতে হবে। কারণ আপনি তো ১৭ লাখ গণকর্মচারীকে বিদায় দিতে পারবেন না, যে তারা সবাই ফ্যাস্টিটের দোসর ছিলেন। এটি অনেক কঠিন। আপনার হাতে লোকজন নেই, এদের নিয়েই আপনার কাজ করতে হবে।’

প্রশাসনে গতি ফেরাতে সরকারের করণীয় বিষয়ে সাবেক এই সচিব বলেন, নেতৃত্বের পর্যায়ে রদবদল এনে তাদের মেসেজ দেবেন। কাজে উৎসাহিত করবেন, তাদের সুরক্ষা দেবেন। তারা যাতে আইনানুযায়ী কাজ করে সেই পরিষ্কার বার্তা তাদের দিতে হবে। আপনি তাদের মনিটর করবেন। সেখানে নেতৃত্বের প্রচণ্ড দুর্বলতা দেখা যাচ্ছে।

প্রায় একই রকম প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশনের সদস্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের সাবেক চেয়ারম্যান ও অধ্যাপক ফেরদৌস আরফিনা ওসমান। তিনি বলেন, ‘প্রশাসন খুব ঢিলেঢালা গতিতে চলছে। আরও শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করা ভালো ছিল। এতো আন্দোলন, যে কঠিন আন্দোলনের পর এ সরকার এসেছে তাকে শক্তভাবে হাল ধরা উচিত ছিল।’

 

তিনি বলেন, ‘এতো আন্দোলন তো আগে ছিল না। আন্দোলন করলে দাবি আদায় হয়, এই মেসেজটা মানুষের কাছে যেতে দেওয়া হলো কেনো? প্রশাসন ভীষণ দুর্বলতার পরিচয় দিয়েছে।’

‘প্রশাসনের ভেতরে প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ করছে না। একটা স্থবিরতার মধ্যে আছে। অনেকে মনে করছেন এ সরকার তো কিছুদিন আছে, নির্বাচন হোক। ভীষণ ধীরগতিতে সবকিছু চলছে। যেভাবে চলা উচিত ছিল, সেভাবে চলছে না প্রশাসন। ব্যক্তিগত চাওয়া-পাওয়ার প্রাধান্যটা বেশি। তাই এটাকে সামনে নিতে পারছে না।’ বলেন আরফিনা ওসমান।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এ শিক্ষক আরও বলেন, ‘খুবই দুঃখজনক যে প্রশাসনে বারবার সিদ্ধান্ত নিয়ে পাল্টাতে হচ্ছে। ভালোভাবে চিন্তা করে তারপর সিদ্ধান্ত নিতে হবে। গেজেট প্রকাশ হলো তারপর যদি আমরা সেই সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করি, এটা সংকেত দেয় যে প্রশাসন শক্তভাবে কাজ করছে না।’

 

প্রশাসনের ছয় মাস নিয়ে কথা বলতে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমানকে একাধিকবার ফোন করা হলে তিনি ফোন ধরেননি।

 

সিদ্ধান্ত গ্রহণে প্রকাশ হচ্ছে নেতৃত্বের দুর্বলতা

দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই প্রশাসনে নেওয়া বিভিন্ন সিদ্ধান্তে নেতৃত্বের দুর্বলতা প্রকাশ পেয়েছে। সেই ধারা এখনও বহাল রয়েছে। শুরুতে জেলা প্রশাসক (ডিসি) পদে নিয়োগ প্রশাসনে চরম বিশৃঙ্খলা ও বিতর্কের জন্ম দেয়। কর্মকর্তারা নিজেদের মধ্যে নজরবিহীনভাবে হাতাহাতিতে জড়িয়ে পড়েন। পরে প্রতিবাদের মুখে ১১ সেপ্টেম্বর ডিসি হিসেবে ৯ কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল করা হয়।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌপরিবহন করপোরেশনের (বিআইডব্লিউটিসি) চেয়ারম্যান (অতিরিক্ত সচিব) এ কে এম মতিউর রহমানকে পদোন্নতি দিয়ে নৌপরিবহন মন্ত্রণালয়ের সচিব হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। কিন্তু ৩ অক্টোবর তাকে ওএসডি করা হয়।

সর্বশেষ গত ১৩ জানুয়ারি বিতর্ক ওঠায় বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশনের (পিএসসি) ছয়জন সদস্যের নিয়োগ বাতিল করা হয়। এর আগে গত ২ জানুয়ারি তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল।

অন্তর্বর্তীকালীন সরকার যুগ্মসচিব থেকে অতিরিক্ত, উপসচিব থেকে যুগ্মসচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে পাঁচ শতাধিক কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়। অভিযোগ ওঠে এদের মধ্যে অনেকেই বিতর্কিত কর্মকর্তা। তাদের কেউ কেউ অতীতে দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভাগীয় মামলায় পেয়েছিলেন শাস্তি। কেউ কেউ ছিলেন পতন হওয়া আওয়ামী লীগের নানা অপকর্মের সহযোগী।

 

গতি নেই কাজে

শক্ত অবস্থান নিয়ে প্রশাসনের কাজে গতি ফেরাতে পারেনি বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা। বড় কোনো নীতি-নির্ধারণী সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। আমলাদের মধ্যে একটি অংশ সরকারকে সহযোগিতা করছে না বলে উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদ সজিব ভূইয়া একাধিকবার জানিয়েছেন। কিন্তু এরপরও গতি আসেনি কাজে। গুরুত্বপূর্ণ ও অগ্রাধিকার কাজগুলো এগোচ্ছে ধীরগতিতে।

রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা প্রত্যাহার, বিনামূল্যের পাঠ্যবই বিতরণ, মন্ত্রণালয় ও বিভাগের প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম কেনাকাটা, গণঅভ্যুত্থানে শহীদ ও আহতদের পরিবারকে সহযোগিতা দেওয়ার মতো অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজ আটকে আছে আমলাতান্ত্রিক গ্যাঁড়াকলে। কোনো কোনো মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের পদ খালি থাকায়ও বিঘ্নিত হচ্ছে কাজের গতি।

 

এখনও ৯ মন্ত্রণালয়-বিভাগে সচিব নেই

শুরু থেকেই বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সচিবের পদ খালি রয়েছে। প্রশাসনিক শীর্ষ পদ খালি থাকায় মন্ত্রণালয়গুলোর সিদ্ধান্ত নিতে সমস্যা হচ্ছে। ওই সব মন্ত্রণালয় কোনো রকমে রুটিন কাজগুলো চালিয়ে নিচ্ছে।

 

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়য়ের তথ্য অনুযায়ী, সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়, সেতু বিভাগ, বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন, বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সচিবালয়, পার্বত্য চট্টগ্রামবিষয়ক মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাস্তবায়ন পরিবীক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ, পরিসংখ্যান ও তথ্য ব্যবস্থাপনা বিভাগে সচিব নেই।

Sharing is caring!