প্রকাশনার ১৫ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

২০শে মার্চ, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
৬ই চৈত্র, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
২০শে রমজান, ১৪৪৬ হিজরি

আরও ভয়ংকর রূপে ‘কিশোর গ্যাং’

editor
প্রকাশিত ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০২৫, ১২:১৬ অপরাহ্ণ
আরও ভয়ংকর রূপে ‘কিশোর গ্যাং’

 

প্রজন্ম ডেস্ক:

সময় বদলালেও পাল্টায়নি ক্রমে আতঙ্ক হয়ে ওঠা ‘কিশোর গ্যাং’ সদস্যরা। ৫ আগস্টের পর কেউ দল বদেলেছে, কেউ বদলেছে আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা। কেউ আবার পুরোনোকে সরিয়ে আবির্ভূত হয়েছে নতুন রূপে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একটি তথ্য বলছে, সম্প্রতি এই গ্যাংয়ের সদস্য আরও বেড়েছে। সারাদেশেই তাণ্ডব চালাচ্ছে তারা।

সম্প্রতি ঘটা কয়েকটি ঘটনায় চোখ রাখা যাক। ৫ ফেব্রুয়ারি প্রজন্ম মোহাম্মদপুরের রায়েরবাজার এলাকায় মাদকবিরোধী অভিযান চলাকালে কিশোর গ্যাংয়ের হামলায় আহত হন পুলিশের চারজন সদস্য। হামলার ঘটনার নেপথ্যে রায়েরবাজার বোর্ড ঘাট এলাকার কিশোর গ্যাং ‘পাটালি গ্রুপ’ জড়িত বলে জানায় পুলিশ। নেতৃত্ব দেয় ল্যাংড়া হাসান, ফরহাদ ও চিকু শাকিল। সবমিলিয়ে হামলা চালায় ৩০-৪০ জন।

 

১ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে রাজধানীর হাতিরঝিল এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের দুই পক্ষের গুলিবিনিময়ের মধ্যে এক কলা ব্যবসায়ী ও কিশোর গুলিবিদ্ধ হয়। পরে তাদের উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এটা ছিল তাদের দুই গ্রুপের আধিপত্য বিস্তারের লড়াই।

গত ১২ নভেম্বর শাখাওয়াত হোসেন ও তার বন্ধু মো. আলমগীর হোসেন উত্তরার জমজম টাওয়ারের সামনে থেকে হাউজ বিল্ডিংয়ে যাওয়ার জন্য অটোরিকশা নেন। তখন আটক এক কিশোরও তাদের সঙ্গে একই রিকশায় ওঠে। যাওয়ার পথে কিশোর গ্যাংয়ের ৭-৮ জনের সহায়তায় দুই বন্ধুকে ভয় দেখিয়ে দুটি মোবাইল ও নগদ ১৯ হাজার ৬০০ টাকা ছিনিয়ে নেওয়া নেয়। পরে তাদের আটকে রেখে পরিবারের কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করে।এভাবে পুলিশও বাদ যাচ্ছে না ভয়ংকর এ গ্যাংয়ের হাত থেকে। স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় সমাজের এহেন বাজে কাজ নেই যাতে তারা করছে না।

 

ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ৪০ শতাংশই কিশোর

ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সদর দপ্তর সূত্র বলছে, ডিএমপির প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর গ্যাং সদস্য রয়েছে। ঢাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত ৪০ শতাংশই কিশোর। আগের চেয়ে তাদের দলের সদস্য সংখ্যা বেড়ে হয়েছে ২০ হাজারের বেশি। তাদের হাতে এখন পিস্তলসহ আধুনিক ধারালো অস্ত্রও রয়েছে।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, শুধু রাজধানীতেই নয়, দেশের প্রতিটি থানা এলাকায় কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের সদস্য বেড়েছে। কিশোর গ্যাংয়ের অপতৎপরতা গ্রামীণ জনপদেও ছড়িয়ে পড়েছে।

দেশে ২৩৭ কিশোর গ্যাং গ্রুপ, ঢাকায় সর্বোচ্চ ১২৭

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ২৩৭টির মতো কিশোর গ্যাং গ্রুপ রয়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ঢাকায় ১২৭টি। সরকার পরিবর্তনের আগে ঢাকায় এসব গ্রুপের সদস্য সংখ্যা ছিল দুই হাজার ৩৮২। বর্তমানে তা আরও বেড়েছে। এখন ঢাকার প্রতিটি থানা এলাকায় ৫০০ থেকে এক হাজার সদস্য রয়েছে। চট্টগ্রামে ৫৭টি গ্রুপে সদস্য ৩১৬।

 

 

৫ আগস্টের পর আরও বেপরোয়া কিশোর গ্যাং গ্রুপ

৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা আরও বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। হঠাৎ সারাদেশে কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা নানামুখী অপরাধে যুক্ত হচ্ছে। নিজেদের হিরোইজম জাহির করতে চাঁদাবাজি, ছিনতাই, মাদক কারবার এমনকি খুনোখুনিতে লিপ্ত হচ্ছে এসব কিশোর-তরুণ। এতে আতঙ্কিত রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন শহর-পাড়া-মহল্লার বাসিন্দারা। আওয়ামী লীগের পতন হলেও দল পাল্টে এখনো অপকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে এসব কিশোর গ্যাংয়ের সদস্যরা। অতীতের মতো এখনো রাজনৈতিক নেতা কিংবা প্রভাবশালী মহলের ছত্রছায়ায় তারা। তবে পুলিশের কাছে শুধু কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধের আলাদা কোনো তথ্য নেই। সদস্য বাড়া ও তাদের সাম্প্রতিক কর্মকাণ্ড বিবেচনায় বলছে কিশোর গ্যাং আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছে।

 

অপরাধ করতে দ্বিধাবোধ করে না কিশোররা

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা বলছেন, সমাজের বিভিন্ন স্তরে মাদকের আগ্রাসন বেশি। এ আগ্রাসনের শিকার হচ্ছে কিশোররা। এ কারণে তারা বিভিন্ন অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করতে দ্বিধাবোধ করছে না। সম্প্রতি অনেক শীর্ষ সন্ত্রাসী জেল থেকে ছাড়া পেয়েছে। তাদের ছত্রছায়ায় থেকে সমাজের বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাণ্ডব চালাচ্ছে। কিশোর গ্যাং সদস্যদের গ্রেফতারের পাশাপাশি তাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতাদেরও আইনের আওতায় আনতে কাজ চলমান।

আদাবর-মোহাম্মদপুরে কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা বেশি

পুলিশের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ঢাকার মধ্যে আদাবর ও মোহাম্মদপুর এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের তৎপরতা সবচেয়ে বেশি। এ দুটি স্থানে একাধিক কিশোর গ্যাংয়ের কয়েক হাজার সদস্য রয়েছে। আদাবর এলাকার আলিফ হাউজিং, শ্যামলী হাউজিং, শেখেরটেক ও ঢাকা উদ্যান এলাকার সব ধরনের অপরাধের সঙ্গে এদের জড়িত থাকার তথ্য পেয়েছে পুলিশ।

এছাড়া মিরপুর, উত্তরা, পুরান ঢাকার বিভিন্ন মহল্লা, ডেমরাসহ রাজধানীর ৫০টি থানা এলাকায় কিশোর-তরুণ গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড আগের চেয়ে বেড়েছে।

পুলিশ বলছে, প্রায় প্রতিদিনই কিশোর গ্যাংয়ের নানা অপরাধের তথ্য ও ভুক্তভোগীদের অভিযোগ আসছে। মাদকের বিস্তার, অর্থলোভ, আইনের তোয়াক্কা না করে নিজেকে বড় ভাবার প্রবণতা, বেকারত্ব, অভিভাবকদের দায়িত্বহীনতাসহ বেশ কয়েকটি কারণে বিপথগামী তরুণরা দিন দিন বেপরোয়া হয়ে উঠছে। অবশ্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীও সজাগ রয়েছে। অভিযোগ পাওয়ার পর অপরাধের ধরন অনুযায়ী আইনানুগ ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। কিশোর অপরাধ কমাতে সামাজিক সচেতনতামূলক নানা কার্যক্রমও চালানো হচ্ছে প্রতিনিয়ত।

যা বলছেন ভুক্তভোগীদের পরিবারের সদস্যরা

গত ৬ জানুয়ারি রাজধানীর মোহাম্মদপুরে পুরাতন বাড়ি ভাঙার সময় দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে চাঁদার জন্য ঠিকদারকে হুমকি দেয় কিশোর গ্যাং চক্রের সদস্যরা। এসময় চাঁদা না পেয়ে শ্রমিকদের মারধর করে বাড়ি থেকে বের করে দেয় তারা।

ভুক্তভোগী ঠিকাদার মো. রহিম জানান, তিনি গত ২৭ ডিসেম্বর মোহাম্মদপুর সাতমসজিদ হাউজিং এলাকার ২ নম্বর রোডে একটি পুরাতন বাড়ি কেনেন। ৬ জানুয়ারি ভাঙার কাজ শুরু করা হয়। এসময় কিশোর গ্যাং চক্রের মূলহোতা ও শীর্ষ সন্ত্রাসী বাবু ওরফে তেরেনাম বাবুর নির্দেশে সোহেল ওরফে ইয়াবা সোহেল, ডিশ শাহিন ও তোতা মিয়াসহ ১৫-২০ জনের একটি দল রামদা, চাপাতি, সামুরাই ও দেশীয় ধারালো অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে এসে দুই লাখ টাকা চাঁদা চেয়ে হুমকি দিয়ে যায়।

গত ২৮ অক্টোবর মোহাম্মদপুরের নবোদয় কাঁচাবাজারের পাশে মোহাম্মদিয়া হোমস গেট এলাকায় ধারালো দেশীয় অস্ত্র-শস্ত্র নিয়ে দোকানের ভেতরে ঢুকে ব্যবসায়ীকে দেখে নেওয়ার হুমকি দিয়ে যায় কিশোর গ্যাংয়ের কয়েকজন সদস্য।

 

কিশোর গ্যাং নিয়ে যা বলছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনী

র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মো. মুনীম ফেরদৌস বলেন, ‘সম্প্রতি অভিযান চালিয়ে মোহাম্মদপুরের ইমন গ্রুপের সদস্যদের গ্রেফতার করেছে র‌্যাব। কিশোর গ্যাং নিয়ন্ত্রণে এর আগেও র‌্যাবের উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রয়েছে। পটপরিবর্তনের পর থেকে এসব কিশোর গ্যাং গ্রুপ কালচার আবার সক্রিয় হওয়া চেষ্টা করছে। এ বিষয়ে কঠোর অবস্থানে র‌্যাব।’

তিনি বলেন, ‘পাড়া-মহল্লার এসব কিশোর গ্যাংয়ের তালিকা তৈরি ও তাদের শনাক্ত করার বিষয়ে র‌্যাবের সব ব্যাটালিয়নকে এরই মধ্যে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কিশোর গ্যাং গ্রুপের পৃষ্ঠপোষকদের শনাক্তেও কাজ করছে র‌্যাবের প্রতিটি ব্যাটালিয়ন।’

ডিবির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ‘৫ আগস্টের পর বেপরোয়া কিশোর গ্যাং সদস্যদের ধরতে ডিবি কাজ করছে। এরই মধ্যে বেশ কয়েকজন গ্যাং সদস্যদের গ্রেফতার করা হয়েছে। যারা কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হবে তাদের আইনের আওতায় আনা হবে।’

ডিএমপির মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান বলেন, ‘রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় কিশোর গ্যাংয়ের অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড দমাতে ডিএমপির ৫০ থানা কাজ করছে। পাশাপাশি গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশও নজরদারি বাড়িয়েছে। ডিমএমপি কমিশনারের নির্দেশনায় ঢাকায় এলাকাভিত্তিক তালিকা তৈরি করে অপরাধে জড়িত কিশোর গ্যাং গ্রুপের সদস্যদের প্রতিদিনই আইনের আওতায় আনা হচ্ছে। সম্প্রতি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে ‘অপারেশন ডেভিল হান্টেও’ কিশোর গ্যাংয়ের সঙ্গে জড়িতদের গ্রেফতার করা হচ্ছে।’

Sharing is caring!