প্রকাশনার ১৬ বছর

রেজি নং: চ/৫৭৫

১০ই ডিসেম্বর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ
২৫শে অগ্রহায়ণ, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ
১৯শে জমাদিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি

হবিগঞ্জের নুরুল হক ‘ম্যানেজ’ না হওয়ায় রাতের ভোট হয়নি একমাত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জে

editor
প্রকাশিত জানুয়ারি ১৫, ২০২৫, ০৬:০৯ পূর্বাহ্ণ
হবিগঞ্জের নুরুল হক ‘ম্যানেজ’ না হওয়ায় রাতের ভোট হয়নি একমাত্র চাঁপাইনবাবগঞ্জে

Manual4 Ad Code

হবিগঞ্জ সংবাদদাতা:
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দিনের ভোট রাতে করার কারিগরা এখন আলোচনায়। তাদের ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু করেছে সরকার। এমনই এক পরিস্থিতিতে আলোচনায় এসেছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক ও রিটানিং কর্মকর্তা এ জে এম নুরুল হকের নাম। রাতের ভোটের কারিগরদের মধ্যে একমাত্র ব্যতিক্রম ছিলেন তিনি। সরকারদলীয় প্রার্থীদের যুদ্ধাংদেহী হুমকি এবং পুলিশ প্রশাসনের প্রচণ্ড চাপেও তিনি ভোটের আগের রাতে ব্যালেটে সিল মারতে রাজি হননি। ফলে এই জেলায় ৩টি আসনের মধ্যে দুটিতে বিপুল ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন বিএনপিদলীয় প্রার্থীরা। ভোটের আগের রাতে জেলার ৩ আসনের সরকারদলীয় প্রার্থীরা জেলা প্রশাসককে মোটা অঙ্কের অর্থ প্রদানের চেষ্টা করেও ব্যর্থ হন। ঢাকা থেকে ঊর্ধ্বতন মহলের ফোনকেও তিনি পাত্তা দেননি।

Manual3 Ad Code

এজেড নুরুল হকের বাড়ি সিলেট বিভাগের হবিগঞ্জ জেলায়। এর আগে তিনি সিলেটের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক ও সিলেট সিটি কর্পোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা হিসেবে সততা, নিষ্টা ও দক্ষতার সাথে দায়িত্ব পালন করেন।

পরে জেলা প্রশাসক থেকে প্রত্যাহারের পর তাকে একের পর এক চরম হয়রানির মুখোমুখি হতে হয়েছে। পোস্টিং দেওয়া হয়েছে খুবই কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে। ডিসি থেকে তুলে এনে ৪ বছরে বদলি করা হয়েছে ৬ বার। শুধু তাই নয়, একটি জলমহাল দখল নিয়ে প্রভাবশালী দুই মন্ত্রীর অনুরোধকে উপেক্ষা করায় তাকে চাকরিচ্যুতির হুমকিও দেওয়া হয়েছিল।

Manual7 Ad Code

এ ব্যাপারে জানতে চাওয়া হলে বর্তমানে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব ও তৎকালীন জেলা প্রশাসক এ জেড এম নুরুল হক বলেছেন, ‘সারা দেশে যাই হয়েছে, তা দেখার দায়িত্ব আমার নয়। আমি একজন সরকারি কর্মকর্তা হিসাবে শতভাগ নিরপেক্ষভাবে আমার দায়িত্ব পালন করেছি। বন্দুকের নলের সামনে মাথানত করিনি। অবশ্য এ জন্য নির্বাচনের পর সিনিয়র কর্মকর্তাদের কাছ থেকে অনেক ভর্ৎসনা পেতে হয়েছে। হয়রানি করা হয়েছে একের পর এক।’

২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগ দলীয় প্রার্থীদের জয়ী করতে তৎকালীন ডিসি-এসপিদের সহযোগিতায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আগের রাতে মোট ভোটের ৪০ ভাগ ব্যালটে সিলে মেরে বাক্সে ঢুকিয়ে রাখে। রাতের ভোটের কারণে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে বিএনপি সারা দেশে আসন পেয়েছিল মাত্র ৫টি। আর তাদের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট বিবেচনা করলে সব মিলিয়ে মাত্র ৭টি। জামায়াত কোনো আসনই পায়নি।

অভিযোগ রয়েছে, ডিসি-এসপি এবং ইউএনও- ওসিরা সে সময় প্রার্থীদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের ‘অর্থ বখশিশ’ পান। সরকারদলীয় প্রার্থীদের জিতিয়ে দেওয়ার নেপথ্যের আলোচিত-সমালোচিত ওই ডিসি-এসপিদের ফাইল ধরছেন জাতীয় রাজস্ব বোর্ড-এনবিআরের কর গোয়েন্দারা। রাতের ভোটের কারিগর বলে পরিচিত এসব ডিসি-এসপির বিপুল অঙ্কের অবৈধ আয়ের কর ফাঁকি অনুসন্ধানে সংস্থাটির আয়কর গোয়েন্দা ও তদন্ত ইউনিট ব্যাপক আয়োজনে মাঠে নেমেছে।

Manual6 Ad Code

তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-এর ডিসির শক্ত অবস্থানের কারণে, সে জেলায় ভোটের চিত্র ছিল ভিন্ন। জেলার ৩টি আসনের মধ্যে দুটিতেই ধরাশয়ী হন আওয়ামী লীগ সমর্থক প্রার্থী। সে সময় চাঁপাইনবাবগঞ্জ-২ (ভোলাহাট, নাচোল ও গোমস্তাপুর) আসনে ঐক্যফ্রন্টের আমিনুল ইসলাম ১ লাখ ৭৫ হাজার ৪৬৬ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। নিকটতম মহাজোটের প্রার্থী মুহা. জিয়াউর রহমান নৌকা প্রতীকে পেয়েছিলেন ১ লাখ ৩৯ হাজার ৯৫২ ভোট।

চাঁপাইনবাবগঞ্জ-৩ (সদর) আসনে ঐক্যফ্রন্টের হারুনুর রশিদ ধানের শীষ প্রতীকে ১ লাখ ৩৩ হাজার ৬৬১ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন। নিকটতম মহাজোটের আব্দুল ওদুদ নৌকা প্রতীকে ৮৫ হাজার ৯৩৮ ভোট। তবে চাঁপাইনবাবগঞ্জ-১ (শিবগঞ্জ) আসনে ১ লাখ ৮০ হাজার ৭৮ ভোট পেয়ে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের সামিল উদ্দীন আহমেদ। নিকটতম ঐক্যফ্রন্টের শাহজাহান মিঞা পান ১ লাখ ৬৩ হাজার ৬৫০ ভোট। নির্বাচনের কিছুদিন পর চাঞ্চল্যকার আরেকটি ঘটনায় সরকারের প্রভাবশালী এক মন্ত্রী ও এক উপদেষ্টা তার ওপর প্রচণ্ড রুষ্ট হন। এ সময় জেলার শিবগঞ্জে সবচেয়ে বড় সরকারি জলমহাল ‘কুমিরাদহ’ লিজ দেওয়া নিয়ে তোপের মুখে পড়েন ডিসি এ জেড এম নুরুল হক।

সরকারি জলমহালটি নিজেদের ব্যক্তিগত মালিকানা দাবি করে তা লিজ দিতে বাধা দেন সাবেক প্রধান বিচারপতি মাইনুর রেজা চৌধুরীর ভাই কাইয়ুম রেজা চৌধুরী। তিনি উচ্চ আদালতে মামলাও করেন। কিন্তু কোনো নিষেধাজ্ঞা না থাকায় জেলা প্রশাসক সরকারি জলমহালটি লিজ দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু করলে সরকারের শীর্ষ মহল থেকে একের পর এক ফোনে লিজ না দিতে বলা হয়। সে সময় প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান টেলিফোনে জেলা প্রশাসককে জলমহাল লিজ না দিয়ে তার বন্ধু কাইয়ুম রেজা চৌধুরীকে বুঝিয়ে দিতে বলেন।

কিন্তু নুরুল হক তা প্রত্যাখ্যান করে উপদেষ্টাকে বলেন, নথি অনুযায়ী এটি সরকারি জলমহাল। আদালতের নির্দেশ কিংবা সরকারি আদেশ ছাড়া এই জলমহাল কাউকে বুঝিয়ে দেওয়া তার পক্ষে সম্ভব নয়। এ সময় উপদেষ্টা চরম উত্তেজিত হয়ে তাকে চাকরিচ্যুত করার হুমকিও দেন। ভূমি মন্ত্রণালয়ের সচিবসহ একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও জলমহালটি লিজ দেওয়া থেকে বিরত থাকতে ডিসিকে বলেন। কিন্তু ডিসি লিখিত চাইলে সবাই তার ওপর চরম বিরক্তি প্রকাশ করেন। এর কিছুদিন পর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বান্ধবীর স্বামী হিসেবে পরিচিত প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী ইমরান আহমেদ কোনো ধরনের সরকারি প্রোগ্রাম ছাড়াই কাইয়ুম রেজা চৌধুরীর আমন্ত্রণে গিয়ে হাজির হন চাঁপাইনবাবগঞ্জে। সার্কিট হাউসে জেলা প্রশাসকের সঙ্গে একান্ত বৈঠকে অনুরোধ করেন জলমহালটি লিজ না দিতে। কিন্তু ডিসি নুরুল হক রাজি হননি।

তিনি মন্ত্রীকে বলেন, সরকার যেহেতু চায়, একটা লিখিত আদেশ দিলেই হয়। আর আদালত কিংবা সরকারের লিখিত আদেশ ছাড়া সরকারের নীতি লঙ্ঘন করতে পারবেন না বলে মন্ত্রীকে বিনয়ের সঙ্গে বলেন। একপর্যায়ে একজন বিতর্কিত ব্যক্তির বাড়িতে মন্ত্রী মধ্যাহ্ন ভোজে যেতে আপত্তি করেন জেলা প্রশাসক। সেদিন কাইয়ুম রেজা চৌধুরী তার বাড়িতে প্রবাসী মন্ত্রীর আগমন উপলক্ষে বিতর্কিত কুমিরাদহ জলমহালে নৌ ভ্রমণের আয়োজন করেছিলেন। মন্ত্রী ইমরান আহমদ জেলা প্রশাসকের আপত্তি উপেক্ষা করে কাইয়ুম রেজা চৌধুরীর বাড়িতে মধ্যাহ্ন ভোজে গেলেও নৌ-ভ্রমণ বাতিল করেন।

এর কয়েকদিন পরই এ জেড এম নুরুল হককে চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক থেকে প্রত্যাহার করা হয়। পদায়ন করা হয় খুবই কমগুরুত্বপূর্ণ ইপিবির পরিচালক পদে। কয়েক মাসের মাথায় সেখানে থেকে জাতীয় সংসদে। সেখান থেকেও কয়েক মাস পর দেওয়া হয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরে। তারপর অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার। সেখানেও টিকতে পারেননি নুরুল হক। প্রভাবশালী মহল তাকে ‘সরকারের অসহযোগী’ আখ্যায়িত করে বদলি করে কর্মচারী কল্যাণ বোর্ডে। সেখান থেকে প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়ে। একাদশ জাতীয় নির্বাচনে সারা দেশে সব ডিসি-এসপিরা সরকারদলীয় প্রার্থীদের বিজয়ী করতে সর্বশক্তি নিয়োগ করে আগের রাতে ভোট করেছেন, সেখানে এক বিরল দৃষ্টান্ত গড়েছিলেন চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসক এ জেড এম নুরুল হক।

Manual1 Ad Code

Sharing is caring!

Manual1 Ad Code
Manual7 Ad Code